একটা ঘরের দিকে আগাইয়া গেল। দরজা খোলা। ভিতরে প্রদীপ জ্বলিতেছে। তার আলোয় উঠানটাও কিঞ্চিৎ আলোকিত। এই আলোতে একটি ছেলেকে সন্দিগ্ধভাবে ঘুরিতে দেখিয়া কারো মনে সন্দেহ ঢুকিয়া থাকিবে, ছেলেট পূজার কোনো দ্রব্য চুরি করিবার তালে আছে। সে খুব জোরে এক ধমক দিল। অনন্ত মাকে খুঁজিতেছে একথা বলিবার অবসর পাইল না। লোকটা আগাইয়া আসিয়া সরিবার পথ দেখাইলে অনন্ত নীরবে পূজামণ্ডপে চলিয়া আসিল।
তাকে অসহায়ের মত দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়া কে একজন দয়াপরবশ হইয়া তার দিকে চাহিল।
‘এই, তুই কার ঘরের?’
অনন্ত এ প্রশ্নের অর্থ বুঝিল না।
‘ও পুলা, তোর বাপ কেডা?’
বাপ নামক পদার্থটা যে কি, অনন্ত তাহা কিছু কিছু বুঝিতে পারে। এই পাড়ার সমবয়সী অনেক ছেলেরই বাপ নামক এক একটি লোক আছে। বাজারের ঘাট হইতে ছোলাভাজা মটরভাজা বিস্কুট কমলা কিনিয়া দেয়। সকালে রাতের জাল বাহিয়া আসিয়া কারে বা কোলে নেয়, কারে বা চুমু খায়, কারে বা মিছিমিছি কাদায়। দুপুরে নিজহাতে তেল মাখাইয়া তিতাসের ঘাটে নিয়া স্নান করায়। পাতে বসাইয়া খাওয়ায়। মাছের ডিমগুলি বাছিয়া বাছিয়া মুখে তুলিয়া দেয়। এসব অনন্তর একদিনের দেখা অভিজ্ঞতা নয়। অনেকদিন দেখিয়া, মনে মনে পর্যালোচনা করিয়া তবে সিদ্ধান্তে আসিয়াছে যে, বাপের এইসব করে। আরো দেখিয়াছে মালো-পাড়ার ছেলেদের গায়ে যে লাল-নীল জামা, এসবও ঐ বাপেরাই কিনিয়া দেয়। যাদের বাপ আছে তারা শীতে কষ্ট পায় না। অনন্ত শীতে কষ্ট পায় তার বাপ নাই বলিয়া। এ ঠিক মার কাজ নয়। কিন্তু তারও বাপ থাকিতে পারে বা কেউ একজন ছিল এ প্রশ্ন কোনোদিন তার মনে জাগে নাই। মাও কোনোদিন বলিয়া দেয় নাই। অথচ মা কত কথা বলিয়া দেয়। বড় অদ্ভূত প্রশ্ন। আগে কেউ এ প্রশ্ন করে নাই। অনন্ত এর কোনো জবাব খুঁজিয়া পাইল না।
‘তুই কার লগে আইছস্?’
এইবারের প্রশ্নটি সোজা। একটু আগেই সে আঁধার জয় করিয়া আসিয়াছে। সঙ্গে তার কেউ ছিল না। জানাইল, একলা আসিয়াছে।
‘এ বলদটা কার ঘরের রে বিপিন?’
বিপিন নামক যুবকটি প্রশ্নকর্তার কৌতুহল এই বলিয়া নিবৃত্ত করিল, তুমি থাক পরের গ্রামে, নিজের গ্রামে কে গেল কে আসিল তুমি কি করিয়া জানিবে। এর মা বিধবা। গায়ে নূতন আসিয়াছে। কালোবরণ বেপারির বাড়ির কাছে বসতি নিয়াছে। রাত পোহাইলে দেখিয়া যাইও ছোট ঘর খানাতে থাকে খায়।
বিপিন একটা পাতলা কাঁথা গায়ে জড়াইয়া উত্তর দিতেছিল। লোকটার কানের কাছে মুখ নিয়া বলিল, ‘ছোট ঘরে বসত করে বড় গুণবতী। হি হি হি।’
অনন্ত কি ভাবিয়া প্রতিবাদ করিল, না না।
কিন্তু তাকে শীতে কাঁপিতে দেখিয়া একজন নিজের দিকে হাতছানি দিয়া ডাকিল।
মণ্ডপের সামনে টিনের চাল বাঁশের খুঁটি দিয়া একখানা ঘরের মত খাড়া করিয়া সামনের দিক খোলা রাখিয়া আর তিনদিক চটে মুড়িয়া দিয়াছে। পূজা হইবে অনেক রাতে। ছেলে বুড়া অনেকেই কাথা নিয়া আসিয়া সেই ঘরের চটের ঢাল বিছানার উপর এখনই শুইয়া পড়িয়াছে। সেই ঘর আর মণ্ডপের মাঝামাঝি স্থানে মোটা মোটা আমের কাঠ দিয়া সারা রাতের মত আগুনের ধুনি করিয়াছে। ইহাকে ঘিরিয়া দশ বার জনে গায়ে গাঁ ঠেকাইয়া বসিয়াছে। হাঁড়ি ভরা তামাক টিকা কাছেই আছে। পাঁচ ছটা হুঁকা জ্বলিতেছে নিবিতেছে। আগুনের তাপে আর তামাকের ধকে তারা একসঙ্গে উত্তাপিত হইতেছে।
এদের সকলেরই দেহে বয়সের ছাপ। কান পর্যন্ত ঢাকিয়া মাথা বাঁধা। কারো কারো গায়ে স্থতি-কম্বল, অনেকের গায়ে কথা। তার উপর মুখে দাড়ি-গোফের জঙ্গল। এই তীব্র আলোকের উজ্জ্বলতায় তাহাদিগকে অপার্থিব দেখাইলে তাহা অনন্তর চোখের দোষ নয়। তাদেরই একজনের আহবানে অনন্ত ধীরে ধীরে দ্বিধা-সঙ্কুচিত চিত্তে তার কাছে গিয়া দাঁড়াইল।
‘শীত করে?’
অনন্ত ঘাড় কাত করিয়া জানাইল, ‘করে।’
‘পিরাণ নাই?’
মাথা নাড়িয়া জানাইল, ‘নাই।‘
‘ইখানে বইয়া পড়্। শরতকাকা, একটু ঘুইরা বও। জাগা দেও। কাঁপ্তাছে।
অনন্ত ঠিক তাদেরই মত করিয়া বসিল। তাদেরই মত করিয়া হাত বাড়াইয়া আগুনের উষ্ণতা ছিনাইয়া আনিয়া গালে মুখে মাখাইতে লাগিল।
সুবলার-বৌ পূজার আয়োজন দেখিতে আসিয়াছিল। ভাড়ার ঘরের বারান্দায় উঠিয়া ডাকিল, ‘অ দিদি, অ অনন্তর মা, দেইখা যাও তোমার অনন্তর কাণ্ড। বুড়ার দলে মিশ্যা তোমার পুলা বুড়া হইয় গেছে।’
পূজার নৈবেদ্যগুলি সাজাইবার পর এই এখন তার ছেলের কথা মনে পড়িয়াছিল। মনে করিয়াছিল হাতে যখন কাজ নাই তখন ছেলেটাকে একবার তালাস করিয়া আসি। এমন সময় সুবলার বৌর ডাক। দেখিয়া তারও হাসি পাইল। বড় করুণও জাগিল ছেলের উপর। ছেলের কেবল আধখানা পিঠ তখন দেখা যাইতেছে। সাতপরতা মেঘে যেমন চাঁদ ঢাকা পড়ে, অনন্তর দেহখানাও বুড়াদের জবর-জঙ্গিমার আড়ালে তেমনিভাবে ঢাকা পড়িয়া গিয়াছে। মা কতক্ষণ দাঁড়াইয়া দেখিল। একসময়ে দেখা গেল, একখানা ছোট হাত দুইপাশের বুড়া দুইজনার কথা-কাপড় সরাইবার দুঃসাধ্য চেষ্টা করিতেছে। কারণ, এই সময় ঠাণ্ডা বাতাস অনুভব করিয়া বুড়ার আগুনের ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করিতেছিল। যাই হোক, চকিতের মধ্যেই মেঘের রাশি অপসারিত করিয়া ছোট মুখখানা জাগিয়া উঠিল। মা এদিকে আছে তারই জন্য বোধ হয় চাঁদ এদিকে ফিরিয়া দেখা দিল।