পথটুকু অতিক্রম করিয়া জমিলা বাহির-বাড়ির মসজিদ-লগ্ন মক্তবের কোণে পা দিয়া একবার পিছন ফিরিয়া চাহিল । তার স্বামী মাঝির সঙ্গে তখনও কেরায়া নিয়া দরদস্তর করিতেছে । দুই-এক আনা ফেলিয়া দিলেই মাঝি খুশি হইয়া চলিয়া যায় । বুড়া মাঝি । যা খাটিয়াছে ! সঙ্গে মাত্র দুই ননদ । তাও ননদের ছোট সংস্করণ ! সন্ধ্যা ঘনাইয়া আসিয়াছে । ভয় করে না বুঝি ! লোকটা যেন কি ! তাদের আসিতে বলিয়া নিজে আসিতেছে না । বাড়ির পথে বড় বড় ঘাস । সাপ বাহির হইয়াছে হইত । ব্যাঙ্ মনে করিয়া এখনই জমিলার পায়ের বুড়ো আঙ্গুলে যদি ছোবল দেয় !
ছমির মিয়া হিসাবী লোক । কাউকে এক পয়সা ঠকায় না । বেহুদা কাউকে এক পয়সা বেশিও দেয় না । সব কাজ ওজন করিয়া করে । মাঝি হাত মানিয়া নৌকায় গিয়া উঠিলে, ছমিরের মনে অনাহূত এক ছোপ প্রসন্নতা রঙ গুলাইয়া দিল । আজ তার কিসের রাত ! এ রাতে কেউ কোন দিন মাঝিকে ঠকায় ! কেউ যেন না ঠকায় !
মাঝি দশ মিনিট ঝগড়া করিয়া যাহা পায় নাই, এক মিনিট চুপ করিয়া তাহার চারিগুণ পাইল ! চক্ চকে সিকিটা শাদা নদীর খোলসা অল্প আলোকে ভালো করিয়া দেখিয়া লইয়া লগিতে ঠেলা দিল ।
ছমির কাছে আসিলে জমিলার মনে হইল – এতক্ষণ এতগুলি সাপ তার পায়ের বুড়ো আঙ্গুলটিকে ঘিরিয়া কিল্ বিল্ করিতেছিল, এখন সব কয়টা সরিয়া পড়িয়াছে । কি ভাল তার মানুষটি !
কিন্তু তার চাইতেও ভাল একজনকে দেখিয়া আসিয়াছে সেই মালোপাড়ার ঘাটে । বড় ভাল লাগিয়াছে তার মানুষটাকে । প্রথম দৃষ্টিতেই সে তাকে ভালবাসিয়া ফেলিয়াছে, সেও কি তেমনি ভালবাসে নাই ? কেমন অনুরাগের ভরে চাহিয়াছিল । আর কেমন মানুষ গো ! একবার দেখিয়াই মনে হইল যেন কতবার দেখিয়াছি । বেলা ফুরাইতেছে । একটু একটু বাতাস বহিতেছে । আর সেই বাতাসে আমার শাড়ির বেড়া খুলিয়া গেল, আর তখনই তাকে আমি দেখিতে পাইলাম । যদি না খুলিত, তবে ত দেখিতেই পাইতাম না । এমনই কত লোককে যে আমরা দেখিতে পাই না । অথচ দেখিতে পাইলে এমনি করিয়া আপন হইয়া যাইত । আমরা কি আর দেখি ? যে দেখাইবার, সে-ই দেখায় ! তা না হইলে সে যখন জলে ঢেউ খেলাইয়া কলসী ডুবাইল, ঠিক সেই সময়ে আমার শাড়ির বাঁধন খুলিল কেন ? বর্ষায় আমার বাপ ওদের গাঁয়ে ভিজা নালিতার আঁটি-বোজাই নৌকা লইয়া যায়, পাট ছাড়াইবার জন্য । আবার যখন বাপের বাড়ি যাইব, বাপকে বলিয়া রাখিব, এই রকম এই রকম মেয়েটি, দেখিতে ঠিক আমার মত । তার বাপকে বলিয়া দেখিও, আমার মেয়ে তোমার মেয়ের সঙ্গে সই পাতিতে চায়, তুমি রাজি আছ কিনা।