কারিগরেরা সে মাটি লাগাইয়া দেহ সংগঠন করিল। মূতির গলার উপর যেদিন মাথা পরান হইল সেদিন মনে হইল এত বড় মূর্তি যেন কথা কহিতে চায়।
মূর্তির গায়ে খড়িগোল লাগাইয়া পালিশ করাতেই অনন্ত ভাবিল কারিগরের কাজ ফুরাইয়াছে, এই মূর্তিরই পূজা হইবে।
‘মূর্তি ত বানান হইল, পূজা কোন দিন?’
‘দূর বলদ, মূর্তির অখনো মেলাই বাকি। সাদা খড়ির উপরে রঙ লাগাইব, নানান রঙের রঙ। যেদিন চক্ষুরদান হইব, সেইদিন কাম সারা। পূজা হইব সেইদিন রাইতে।‘
সুবিজ্ঞ সাথীর আশ্বাস অন্তরে নিয়া অনন্ত পরের দিন গেল। কিন্তু নিরাশ হইল। পাল খাটাইয়া মণ্ডপের সামনাটা ঢাকিয়া দিয়াছে। কারিগরদের যাওয়া-আসার জন্য একটুখানি ফাক আছে এক কোণে। সেখানে চোখ ডুবাইয়া দেখা গেল ছোট ছোট অনেক বাটিতে অনেক জাতের রঙ গোল রহিয়াছে। সেই রঙে তুলি ডুবাইয়া কারিগরের দ্রুত বেগে চালাইতেছে, আর প্রতিমা প্রতিক্ষণে নব নবরূপে বিচিত্র হইয়া উঠিতেছে।
কালোর-মা-ই নির্দিষ্ট করিয়া দিল, কাল যে কালীপূজা হইবে, তাতে কালোর-মা, অনন্তর-মা আর বৃন্দার-মা সংযমী থাকিবে। সংযমী যারা থাকে তারা আগের দিন নিরামিষ খায়, পূজার দিন প্রাতঃস্নান করে। পূজার জল তোলে, ফুল বাছাই করে, ভোগ নৈবেদ্য সাজায় আর ফুলের মালা গলায় নামাবলী গায়ে যে পুরোহিত পূজায় বসে তার নির্দেশ মতো নানা দ্রব্য আগাইয়া দেয় এবং প্রতিমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধযুক্ত নানা কাজ করে। কম গৌরবের কথা নয়। তারা পুরোহিতের সাহায্যকারিণী। অর্ধেক পূজা তারাই সমাধা করে। পুরোহিত তো কেবল মন্ত্রের জোরে। অনন্তর মার গৌরব বাড়িল। কিন্তু সুবলার বৌয়ের জন্য দুঃখ পাইল। সে এসব কাজে কত পাক অথচ কালোর মা তাকেই কিছু বলিল না।
সারাদিন এক ফোঁটা জল মুখে না দিয়া কারিগরেরা তুলির শেষ পোঁচ লাগাইয়া যখন পরদা সরাইল, আকাশের আলো ফুরাইয়াছে বলিয়া তখন পালের নিচে গ্যাসের আলোর আয়োজন চলিতেছে।
মা বলিয়া দিয়াছে, অত বড় প্রতিমা, প্রথমে পায়ের দিকে চাহিও, তারপর ধীরে ধীরে চূড়ার দিকে। একেবারেই মুখের দিকে চাহিলে ভয় পাইবে। সে-কথা ভুলিয়া গিয়া অনন্ত একেবারেই মুখের দিকে চাহিল কিন্তু ভয় পাইল না।
একটু পরেই দেখা গেল নৈবেদ্য হাতে করিয়া মা পূজারিণীর বেশে মণ্ডপে ঢুকিতেছে। শুদ্ধ শান্ত ধবলী বেশ। নূতন একখানা ধবধবে কাপড় পরিয়াছে মা। কোথায় পাইয়াছে কে জানে! কিন্তু এই বেশে মাকে যা সুন্দর দেখাইতেছে। মণ্ডপের বাহিরে একটা বাঁশবাঁধা। তার ওপাশে কাহাকেও যাইতে দেয় না। কেউ গেলে ধমক খাইয়া ফিরিয়া আসে। এ অভিজ্ঞতা তার নিজেরও হইয়াছে। আর তারই মা কিনা অত সব পূজাসামগ্ৰী লইয়া মণ্ডপের ভিতরে একেবারে প্রতিমার গাঁ ঘেঁষিয়া দাঁড়াইয়াছে! এত কাছে যারা যাইতে পারিয়াছে তারা সামান্ত নয়। অনন্তর মত এত সামান্ত ত নয়ই, তাদের সঙ্গে নিশ্চয়ই দেবতার কথাবার্তা চলে। মার প্রতি অনন্তর অনির্বচনীয় শ্রদ্ধা জন্মিল। অথচ এই মা’ই তাহাকে কোলে তুলিয়াছে, খাওয়াইয়াছে পরাইয়াছে। একান্ত ইচ্ছা করিতেছে মা একবার তার দিকে দৃষ্টিপাত করুক। তার দৃষ্টির প্রসাদ ঝরিয়া পড়ুক অনন্তর চোখেমুখে। কিন্তু না, বড় দুর্ভাগা সে। মা কোনোদিকে না চাহিয়া চলিয়া গেল। একবার চাহিয়াও দেখিল না, তারই ছেলে অনন্ত দীনহীনের মত দূরে দাঁড়াইয়া। মার জন্য অনন্ত খুব গর্ববোধ করিল।
তারপর অনেকক্ষণ মাকে আর দেখা গেল না। বোধ হয় বাড়ি চলিয়া গিয়াছে।
বাহিরে অমাবস্যার অন্ধকার। পালের বেড়া দেওয়া তীব্র আলোর রাজ্য হইতে বাহির হইয়া একেবারে অন্ধকারের সমুদ্রে গিয়া পড়িল। কোনমতে পথ চিনিয়া বাড়িতে আসিয়া দেখে দ্বার বন্ধ। মা আসে নাই। এত রাত। এত অন্ধকার। সে এখন যায় কোথায়। আবার সেখানে একা একা ফিরিয়া যাওয়া। একথা যে ভাবাও যায় না। তবু যাইতে হইবে। দুঃসাহসের জয়যাত্রা তাকে এখনই শুরু করিতে হইবে। তুর্জয় সাহসে বুক বাঁধিয়া অনন্ত কোনো দিকে না চাহিয়া পথ বাহিয়া চলিল। গল্পের মধ্যে যাদের কথা সে শুনিয়াছে এখন তাদের সঙ্গে যদি দেখা হইয়া যায়। না তাদের কারো সঙ্গেই পথে দেখা হইল না। তার বোধ হয় জানে না অনন্ত আঁধারে একা এপথ দিয়া যাইতেছে। জানিলে আসিত। অনেক লোক লইয়া তাদের কারবার। অনন্তর মত এত ছোট মানুষ কাউকে ভুলিয়া যাওয়া তাদের অসম্ভব নয়। তার আত্মসন্মানে আঘাত পড়িল। সে তাদের কথা আত জানে, অথচ অনন্তর কথা তারা জানে না।
এই বাড়িতেই পূজার সবকিছু দ্রব্য রাখা হইয়াছে। তার মা এই বাড়িতেই কোনো একটা ঘরে আছে হয়ত। অনেকগুলি পুজার উপকরণ সামনে লইয়া প্রদীপের পাশে বসিয়া আছে প্রতিমার মত। কাছে দেখিতে পাইয়া অনন্তকে তাড়াইয়া দিবে না ত? পূজার জন্য মা তার কাপড়খানা পরিষ্কার করিয়া দিলেও, মার মত অত পরিষ্কার নয়। আর তাকে অত সুন্দর কোনোকালেই দেখাইবে না। তবে ত এখন মার কাছে যাওয়া ঠিক হইবে না। কিন্তু আজ অন্ধকারে যে দুরন্ত সাহসের কাজ সে করিয়া ফেলিয়াছে, মা যদি তাহ। জানে তবে নিশ্চয় তাকে কাছে ডাকিয়া নিয়া কোলে ঠিক না বসাইলেও পাশে বসাইয়া বলিবে, তুমি অমন ভাবে আঁধারে এক পথ চলিও না। সে বলিবে, তাতে কি মা, আমার তেমন ভয় করে নাই ত। মা বলিবে, তোমার ভয় না করিতে পারে কিন্তু আমার ভয় করে। তুমি আঁধারে হারাইয়া গেলে তোমার মত এমন আর একটি অনন্তকে আমি কোনকালে পাইব না। মা তাহা হইলে সত্য কথাই তো বলিবে। কোথায় পাইবে আমার মত আরেকটিকে। তেমন কাউকেও দেখি না ত। না, মাকে কথাটা বলিতেই হইবে।