যেদিন বিবাহ হইবে সেদিন বৈকালে কয়েকজন বর্ষীয়সী অনন্তর মার বাবান্দায় পাড়া-বেড়াইতে আসিল। তারা প্রথমেই তুলিল আজকের বিবাহের কথা।
একজন বলিল, ‘নন্দর-মা আছিল বেপারির পয়ল বিয়ার বৌ আমার বাপের দেশে আছিল তারও বাপের বাড়ি। এক বছরই দুইজনার জন্ম, বিয়াও হইছে একই গাওয়ে। সে পড়ল বড় ঘরে আমি পড়লাম গরীবের ঘরে। তার হাতে উঠল সোনার কাঠি আমার হাতে ভাতের কাঠি। থাউক সেই কথা কই না, কই ভইন এই কথা, আজ যার সাথে বিয়া হইতাছে—এযে নন্দর-মার নাতিনের সমান। এরে লইয়া বুড়া করব কি গো? এর যখন কলি ছিট্ব বুড়া তখন ঝইরা পড়ব।‘
অন্যমনস্ক অনন্তর মার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া অন্ত একজন বলিল, ‘কাকের মুখে সিন্দুইরা-আম লো মা।‘
তৃতীয়ার মনের বনে রঙের ছোঁয়া লাগিয়াছে। প্রবীনা হইলেও মন বুঝি তার মস্গুল। পরের বিবাহের বাজনা শুনিলেই নিজের বিবাহের দিনটির কথা মনে পড়ে। মনের খুশি চাপিতে না পারিয়া অনন্তকে লইয়া পড়িল, ‘কিরে গোলাম! বিয়া করবি?’
বিবাহের কথা অনন্ত তিন চার দিন ধরিয়া শুনিতেছে। কথাবার্তার ধরণ হইতে আসলবস্তু কিছু বুঝিতে না পারিলেও এটুকু বুঝিয়াছে বিবাহ করা একটা খারাপ কিছু নয়। অতি সহজভাবে সে উত্তর দিল, ‘করমু।’
‘ক দেখি, বিয়া কইরা কি করে।’
প্রশ্নটা একটু জটিল ঠেকিল। কিন্তু খানিক বুদ্ধি চালনা করিয়া বেশ সপ্রতিভ ভাবেই জবাব দিল, ‘ভাত রান্ধায়।’
‘হি হি হি, কইতে পারলি না গোলাম, কইতে পারলি না। বিয়া কইরা লোকে বৌয়ের ঠ্যাং কান্ধে লয়, বুঝলি, হি হি হি।’
উত্তরটা অনন্তর মনঃপুত হইল না মোটেই। ভাবিল উহু, এ হইতেই পারে না। কিন্তু সত্য হইলে ত বিপদ।
‘আমারে বিয়া করবি?’
মোটা মোটা ঠ্যাং দুটির দিকে ভয়ে ভয়ে তাকাইয়া অনন্ত বলিল, ‘না।’
সন্ধ্যার পর মার সঙ্গে বিবাহ দেখিতে গিয়া অনন্ত বিস্ময়ে বিমূঢ় হইয়া গেল। সে যেন বিবাহ দেখিতেছে না, একটা চমৎকার গল্প শুনিতেছে। প্রভেদ শুধু এই, গল্প যে বলিতেছে তাকে দেখা যাইতেছে না, আর তার কথাগুলি শোনা যাইতেছে না। সে যা যা বলিতেছে অনন্ত সে-সব চোখের সামনে দেখিতেছে।
সামনে যে টোপর মাথায় চুপ করিয়া বসিয়া আছে, সে বিরাট এক দৈত্য। ছোট মেয়েটাকে তার দলের লোকেরা ধরিয়া আনিয়া তার গুহার মধ্যে বন্দী করিয়া রাখিয়াছে। মেয়েটা চাহিয়া দেখে চারিদিকে লোকজন, পালাইবার চেষ্টা করিয়া কোন ফল হইবে না। তার চেয়ে এই ভাল। আপাততঃ দৈত্যকে ঘুরিয়া প্রদক্ষিণ করিতে করিতে তার মাথায় ফুল ছড়াইয়া তাকে তুই রাখা চলুক। তার লোকজন অন্যমনস্ক হইলে যেই একটু ফাক পাওয়া যাইবে অমনি মেয়েটি এখান হইতে পলাইয়া যাইবে। কোথায় যাইবে? যেখানে তার জন্য খেলার সার্থীরা প্রতীক্ষা করিয়া আছে। পালাইয়া অনন্তদের বাড়ীতে গিয়া উঠিলে মন্দ হয় না। মা তাকে কিছুদিন লুকাইয়া রাখিবে। দৈত্যটা তাকে পাড়াময় বৃথাই খুঁজিয়া মরিবে। পাইবে না। অবশেষে একদিন মনের দুঃখে তিতাসের জলে ডুবিয়া মরিবে।
অনন্তর ধ্যান ভাঙ্গিল তখন, যখন বড় বাতাসার হাঁড়ি হাতে একজন একমুঠা বাতাসা তুলিয়া তার হাতের কাছে নিয়া বলিল, ‘এই নে, বাতাসা নে। কোন দিকে চাইয়া রইলি?’
অনন্ত হাত পাতিয়া বাতাসা লইল। ততক্ষণে বিবাহ শেষ হইয়া গিয়াছে এবং বিবাহ সমাপ্তির মধু-চিহ্ন রূপে নাপিত ভাই ‘গুরুবচন’ বলিতেছে—
শুন শুন সভাজন শুন দিয়া মন,
শিবের বিবাহ কথা অপূর্ব কথন।
কৈলাস-শিখরে শিব ধ্যানেতে আছিল,
উমার সহিতে বিয়া নারদে ঘটাইল।
শিবেরে দেখিয়া কাঁদে উমাদেবীর মা,
এমন বুড়ারে আমি উমা দিব না।…
শিবেরে পাইয়া উমা হরষিত হইল,
সাঙ্গ হইল শিবের বিয়া হরি হরি বল।
গুরুবচনের মাঝখানটায় শ্যামসুন্দর চমকাইয়া উঠিয়াছিল : এ সব কথা ঠিক তাহাকে উদ্দেশ করিয়া বলিতেছে না ত! যা হোক, বচনের শেষের দিকটা আশাপ্রদ। উমার মা যাহাই মনে করুক না কেন, উমা নিজে খুশি হইয়াছে।
বিবাহবাড়ি খালি হইবার আগেই অনন্তর মা অনন্তকে হাত ধরিয়া বাড়ির পথে পা দিয়াছিল। পথে চলিতে চলিতে হাতের বাতাসাগুলিকে অনন্তর অকিঞ্চিৎকর মনে হইতে লাগিল। মনের দিক দিয়া সে এই একটি দিনের অভিজ্ঞতাতেই অনেকখানি আগাইয়া গিয়াছে। কয়েকটা অজানার আগল ধীরে ধীরে খুলিয়া গিয়াছে।
এই বিবাহেও শ্যামসুন্দর অনেক টাকা খরচ করিয়াছে। মালোপাড়ার সবাইকে পরিতৃপ্তির সহিত ভোজন করাইয়াছে।
কিন্তু কালীপূজাতে হয় সব চাইতে বেশী সমারোহ। বিদেশ হইতে কারিগর আসে। পূজার একমাস আগে মূর্তি বানানো শুরু হয়।
প্রকাণ্ড বাঁশের কাঠামটা ছিল অনন্তর চোখে পরম বিস্ময়। তৈরী করিতে পাঁচদিন লাগিল। এক বোঝাই খড় আসিলে, পাটের সরু দড়ি দিয়া খড় পেঁচাইয়া তৈরী হইল নির্মস্তক সব মূর্তি। সেগুলি কেবল বাঁশের উপর খাড় করা; খাড়া কাঠামে পিঠ-লাগানো। মানুষের আকার নিয়াছে হাত পা শরীরে, নাই কেবল মাথা।
একদিন এক বোঝাই মাটি তিতাসের ঘাটে লাগিল। ছোট করিয়া কাটা পাটের কুচি সে মাটির সঙ্গে মিশাইয়া জল ঢালিয়া মালোর ছেলেদের জিন্মায় দেওয়া হইল। তারা নাচিয়া কুদিয়া পাড়াইয়া মাড়াইয়া সে মাটি নরম করিল। এই মাটিতে আকাশ-ছোঁয়া মূৰ্তি তৈয়ার হইবে। সে মাটির কাজ করা বড় গৌরবের, বিশেষ ছেলেদের পক্ষে।