একটা নেকড়ার সাহায্যে তুলিয়া কালোর মা দরজার কাছে আনিল সমাগতা নারীদিগকে দেখাইবার জন্ত। সকলেই দেখিবার জন্য ঝুঁকিয়া পড়িল। অনন্ত একবার দেখিয়া পিছাইয়া গেল।
ছয় দিনের দিন ঘরে দোয়াত কলম দেওয়া হইল। এই রাতে চিত্রগুপ্ত আসিয়া সেই দোয়াত হইতে কালি তুলিয়া সেই কলমের সাহায্যে শিশুর কপালে লিখিয়া যায় তার ভাগ্যলিপি।
অষ্টমদিনে আট-কলাই। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে অনন্তরও ডাক পড়িল। খই, ভাজ-কলাই, বাতাসা সেও কোচড় ভরিয়া পাইল।
তের দিন পরে অশৌচ-অন্ত। সব কিছু ধোঁয়া-পাখ্লার পর নাপিত আসিয়া কালোবরণাদি তিন ভাইয়ের তের দিনের খাপছাড়া দাড়ি কামাইয়া গেল। মন্ত্র পড়িয়া পুরোহিত উঠিয়া গেলে, উঠানে একটি চাটাই পাতিয়া তাতে ধান ছড়াইয়া দেওয়া হইল। নূতন একটা শাড়ি পরিয়া, নূতন একটা রঙিন বড় রুমালে জড়াইয়া ছেলেকোলে মেজবে বাহির হইল! চাটাইর উপর উঠিয়া ধানগুলি পা দিয়া সারা চাটাইয়ে ছড়াইয়া দিল। এদিকে পুরনারীরা এক সঙ্গে গলা মিলাইয়া গাহিয়া চলিল, ‘দেখ রাণী ভাগ্যমান, রাণীর কোলেতে নাচে দয়াল ভগবান। নাচ রে নাচ রে গোপাল খাইয়া ক্ষীর ননী, নাচিলে বানাইয়া দিব হস্তের পাচনি। একবার নাচ দুইবার নাচ তিনবার নাচ দেখি, নাচিলে গড়াইয়া দিব হস্তের মোহন বাশি।‘
দক্ষিণা দিয়া বিদায় করিতে করিতে কালোবরণ পুরোহিতকে বলিল, দেখেন ত কর্ত, মুখে-পস্সাদের ভাল দিন নি আছে। দুই কাম এক আয়োজনেই সারা করতে চাই, কি কন।‘
পঞ্জিকা দেখিয়া পুরোহিত বলিয়া দিল, পরশুই একটা ভাল দিন অন্নপ্রাশনের।
ছোটবউর ছেলে বাড়িয়া উঠিতেছে। বসিয়া নিজের চেষ্টাতে মাথা ঠিক রাখিতে পারে। কিন্তু ইদানীং অত্যন্ত পেটুক হইয়া উঠিয়াছে। যাহা পায় খাদ্যাখাদ্য বিচার না করিয়া মুখে পুরিয়া দেয়। কালোর মা বলে, মুখে-প্রসাদ দেওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়।
কাজেই দুইদিন পরেই বাড়িতে আরো একটা উৎসবের আয়োজন হইল।
সেদিনও অনস্তর মার ডাক পড়িল। আরো অনেক নারীর ডাক পড়িল। গীত গাহিবার জন্য।
প্রথমে স্নানযাত্রা। ছেলেকোলে ছোটবোঁকে মাঝখানে করিয়া গান গাহিতে গাহিতে নারীরা তিতাসের ঘাটে গেল। ছোট বোঁ তিতাসকে নিজে তিনবার প্রণাম করিল, ছেলেকেও তিনবার প্রণাম করাইল। এক অঞ্জলি জল লইয়া তার মাথ৷ ধোঁয়াইল। শাড়ির আঁচল দিয়া মুছিয়া নদীকে আবার নমস্কার করিয়া বাড়ি ফিরিয়া আসিল।
এক মুহূর্ত বিশ্রাম করিয়া তার চলিল রাধামাধবের মন্দিরে। সঙ্গে একথালা পরমান্ন। সেখানে পরমান্নকে নিবেদন করিয়া প্রসাদ করা হইল। ছোট বউ একটুখানি তুলিয়া ছেলের মুখে পুরিয়া দিল, বাকি সবটাই উপস্থিত ছেলেদের মধ্যে বিতরণ করা হইল।
মালোর বিবাহে সবচেয়ে বেশি উল্লাস পায়। বিবাহ করিয়া সুখ, দেখিয়া আনন্দ। বিবাহ যে করিতেছে তার তো সুখের পার নাই। পাড়ার আর সব লোকেরাও মনে করে, আজকের দিনটা অতি উত্তম।
যারা সবচেয়ে প্রিয়, যারা সবচেয়ে নিকটের, তাদের বিবাহ করিয়া বউ লইয়া আমোদ-আহ্লাদ করিতে দেখিলে মালোর খুব খুশি হয়। যে বিবাহও করিতে পারে না, সে রাত কাটায় নৌকাতে। এ পাড়ার গুরুদয়াল সেই দলের। বয়স চল্লিশের উপর।
তার সঙ্গে একদিন নৌকাতে কালোবরণের ছোট ভাইয়ের ঝগড়া হইয়া গেল।
গুরুদয়াল বলিয়াছিল সেদিন বাজারের ঘাটে, তিন বিবাহের তিন ছেলের বাপ হইয়া শ্যামসুন্দর বেপারি আবার যদি বিবাহ করে তো পুবের চাঁদ পশ্চিমে উদয় হইবে।
কালোর ভাই প্রতিবাদ করিয়াছিল, রাখিয়া দেও। কাঠের কারবার করিয়া অত টাকা জমাইয়াছে কোন দিনের জন্তে। শেষকালে স্ত্রী কাছে না থাকিলে বেপারি কি রাত কাটাইবে তুলার বালিশ বুকে লইয়া? একবার যখন মুখ দিয়া কথা বাহির করিয়াছে, তখন বিবাহ একটা না করিয়া ছাড়াছাড়ি নাই।
‘হ। কইছ কথা মিছা না। শেষ-কাটালে ইস্তিরি কাছে না থাকলে মরণ-কালে মুখে একটু জল দিবে কেডায়? পুত ত কুত্তার মুত।‘
কালোর ভাই সম্প্রতি একটি পুত্র লাভ করিয়াছে। সে এখন পুত্রগর্বে গর্বিত। পুত্র জাতটার উপর এই একচেটিয়া অপবাদ দিতে দেখিয়া সে চটিয়া উঠিল, “তুমি যেমুন আঁটকুড়ার রাজা, কথাখানও কইছ সেই রকম।
পিতৃত্বহীনতার অপবাদ। অসহ। গুরুদয়ালের মুখ দিয়া অভিশাপ বাহির হইল, ‘অখন থাইক্যা তোরেও যেন ঈশ্বরে আঁটকুড়া বানাইয়া রাখে।‘
‘দূর হ, শ্যাওড়াগাছের কাওয়া, এর লাগি-ঐ তোর চুল পাকছে, দাড়ি পাকছে, তবু শোলার মুটুক মাথায় উঠ্ল না।’
‘নইদার পুতে কি কয়! আমার মাথায় শোলার মুটুক উঠ্ল না, তার লাগি কি তোর মাথা মুয়ান লাগছে দশজনের বৈঠকে? আমি কি রাইতকালে গিয়া তোর ঘরের বেড়া ভাঙছি কোনোদিন, কইতে পারবে?’
‘খাড় হেই শালা গুরু-দাওয়াল, অখনই বাপের বিয়া মার সাঙ দেখাইয়া দেই।‘
এ নৌকা হইতে কালোর ভাই লগির গোড়া গুরুদয়ালের মাথা লক্ষ্য করিয়া ঘুরাইল। ও নৌকা হইতে গুরুদয়ালও একটি লগি তুলিয়া আঘাত করিতে উদ্যত হইল।
নৌকার অন্যান্য লোক ব্যতিব্যস্ত হইয়া উঠিল। কেউ বলিল, ‘আরে রামনাথ ক্ষেমা দে।‘ কেউ বলিল, ‘ও গুরুদওয়াল, ভাটি দেও। রামনাথ অবুজ হইতে পারে, তুমি ত অবুজ না।‘
শেষে কালোর ভাইয়ের কথাই ঠিক হইল। শ্যামসুন্দর বেপারি উত্তর মুলুক হইতে কাঠ আনাইয়া এখানে কারবার করে। সেই মুলুক হইতে একটা লোক রেলগাড়িতে করিয়া বৌ-নিয়া তার বাড়িতে আসিল। শামসুন্দরের নিজে যাইতে হইল না। চিঠিপত্রেই সব হইয়া গেল।