যারা বিজয় নদীর দশা দেখে নাই, বছরের পর বছর কেবল তিতাসের তীরেই বাস করিয়াছে, তারা এমন করিয়া ভাবে না । তারা ভাবে তিন-কোণা ঠেলা-জাল আবার একটা জাল ! তারে হাঁটু-জলে ঠেলিতে হয়, উঠে চিংড়ির বাচ্ছা । হাত তিনেক তো মোটে লম্বা । বিজয়ের বুকে তা-ই ডোবে না । তিতাসের জলে কত বড় বড় জাল ফেলিয়া তারা কত রকমের মাছ ধরে । এখানে যদি তিতাস নদী না থাকিত, বিজয় নদী থাকিত, তবে নাকের চারিদিক থেকে বায়ুটুকু সরাইয়া রাখিলে যা অবস্থা হয়, তাদের ঠিক সেই রকম অবস্থা হইত । ওদের মতো থেলা-জাল ঘাড়ে করিয়া গ্রামগ্রামান্তরের খানা-ডোবা খুঁজিয়া মরিতে হইত দুই আনা এর দশ পয়সার মোরলা ধরিবার জন্য ।
জেলেদের বউ-ঝিরা ভাবে অন্যরকম কথা – বড় নদীর কথা যারা শুনিয়াছে । যে-সব নদীর নাম মেঘনা এর পদ্মা । কি ভীষণ ! পাড় ভাঙ্গে । নৌকা ডোবায় । কি ঢেউ । কি গহীন জল । চোখে না দেখিয়াই বুক কাঁপে ! কত কুমীর আছে সে-সব নদীতে । তাদের পুরুষদের মাছ ধরার জীবন । রাতে-বেরাতে তারা জলের উপরে থাকে । এতবড় নদীতে তারা বাহির হইত কি করিয়া ! তাদের নদীতে পাঠাইয়া মেয়েরা ঘরে থাকিতই বা কেমন করিয়া ! তিতাস কত শান্ত । তিতাসের বুকে ঝড়-তুফানের রাতেও স্বামীপুত্রদের পাঠাইয়া ভয় করে না । বৌরা মনে করে স্বামীরা তাদের বাহুর বাঁধনেই আছে, মায়েরা ভাবে ছেলেরা ঠিক মায়েরই বুকে মাথা এলাইয়া দিয়া শান্ত-মনে মাছ-ভরা জাল গুটাইতেছে ।
বাংলার বুকে জটার মতো নদীর প্যাঁচ । শাদা, ঢেউ-তোলা জটা । কোন্ মহাস্থবিরের চুম্বন-রস-সিক্ত বাংলা । তার জটাগুলি তার বুকের তারুণ্যের উপর দিয়া সাপ-খেলানো জটিলতা জাগাইয়া নিম্নাঙ্গের দিকে সরিয়া পড়িয়াছে । এ সবই নদী ।
সবগুলি নদীর রূপ এক নয় । উহাদের ব্যবহার এবং উহাদের সহিত ব্যবহার তাও বিভিন্ন রকমের । সবগুলি নদীই মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের কাজে আসে । কিন্তু এ কাজে আসার নানা ব্যতিক্রম আছে । বড় নদীতে সওদাগরের নৌকা আসে পাল উড়াইয়া । উহার বিশাল বুকে জেলেরা সারাদিন নৌকা লইয়া ভাসিয়া থাকে । নৌকায় রাঁধে, খায়, ঘুমাইয়া থাকে । মাছ ধরে । সব বিষয়ে একটা কোঠর রূপ এখানে প্রকটিত । তীরে তীরে বালুচর, তাল নারিকেল সুপারির বাগ । স্রোতের খরায় তীরের মাটি কাটে, ধ্বসে । ঢেউয়ের আঘাতে তীরগুলি ভাঙিয়া খসিয়া পড়ে । গৃহস্থালি ভাঙ্গে । ক্ষেত খামার ভাঙ্গে, তাল-নারিকেল, সুপারির গাছগুলি সারি বাঁধিয়া ভাঙিয়া পড়ে । ক্ষমা নাই । ভাঙ্গাগড়ার এক রুদ্র দোলার দোলনায় করাল এক চিত্তচঞ্চল ক্ষিপ্ত আনন্দ । সে-ই এক ধরণের শিল্প ।
শিল্পের আরেকটা দিক আছে । সৌম্য শান্ত করুণ স্নিগ্ধ প্রসাদগুণের মাধুর্যে রঞ্জিত এ শিল্প । এ শিল্পের শিল্পী মহাকালের তাণ্ডবনৃত্য আঁকিতে পারে না । পিঙ্গল জটার বাঁধন খসিয়া পড়ার প্রচণ্ডতা এ শিল্পীর তুলিকায় ধরা দিবে না । এ শিল্পের শিল্পী মেঘনা, পদ্মা, ধলেশ্বরীর তীর ছাড়িয়া তিতাসের তীরে আঙিনা রচনা করিয়াছে ।
এ-শিল্পী যে-ছবি আঁকে তা বড় মনোরম । তীর-ঘেঁসিয়া সব ছোট ছোট শিল্পী । তারপর জমি । তাতে অঘ্রাণ মাসে পাকা ধানের মৌসুম । মাঘ মাসে সর্ষেফুলের অজস্র হাসি । তারপর পল্লী । ঘাটের পর ঘাট । সে ঘাটে জীবন্ত ছবি । মা তার নাদুস-নুদুস ছেলেকে ডুবাইয়া চুবাইয়া তোলে । বৌ-ঝিরা সব কলসী লইয়া ডুব দেয় । পরক্ষণে ভাসিয়া উঠে । অল্প দূর দিয়া নৌকা যায়, একের পর এক । কোনটাতে ছই থাকে, কোনটাতে থাকে না । কোনো কোনো সময় ছইয়ের ভিতর নয়া বউ থাকে । বাপের বাড়ি থেকে স্বামী তার বাড়িতে লইয়া যায়; তখন ছইয়ের এ-পারে ও-পারে থাকে বউয়ের শাড়ি-কাপড়ের বেড়া । স্বামীর বাড়ি থেকে যখন বাপের বাড়িতে যায়, তখন কিন্তু কাপড়ের বেড়া থাকে না । থাকে না তার মাথায় ঘোমটা । ছইয়ের বাহিরে বসিয়া ঘাটগুলির দিকে চাহিয়া থাকে সে । স্বামীর বাড়ির ঘাট অদৃশ্য না হইলে কিন্তু সে ছইয়ের বাহিরে আসে না ।
তারা স্বামীর বাড়ি থেকে বাপের বাড়ি আর বাপের বাড়ি থেকে স্বামীর বাড়ি যায় অনেক হাসি-কান্নার ঢেউ বুকে লইয়া । যে বৌ স্বামীর বাড়ি যায়, তার এক চোখে প্রজাপতি নাচে, আরেক চোখে থাকে জল । এরা সব ভিন্ জাতের বৌ । বামুন, কায়েত, নানা জাতের । জেলেদের বৌরা জেলে-নৌকাতেই যায় । তারা অত সুন্দরীও নয় । অত তাদের আবরুরও দরকার হয় না । কিন্তু ওরা খুব সুন্দরী । জেলের ছেলেরা কপালের দোষ দেয় । অমন সুন্দর বৌ তাদের জীবনে কোনদিন আসিবে না । ভালো করিয়া চায় তারা । ভালো করিয়া চাহিতে পারিলে প্রায়ই ছইয়ের ফাঁক দিয়া, বাতাসে শাড়িটা একটু সরিয়া গেলে, চকিতে তারই ফাঁক দিয়া, টুকটুকে একখানা মুখ আর এক জোড়া চোখ চোখে পড়িবে । বৌয়ের অভিভাবক ছইয়ের দুই মুখে গুঁজিয়া দিয়াছে শাড়ির বেড়া; তাতে বৌকে সকলে দেখিতে পারে না, কিন্তু বৌ সকলকে দেখিতে পায় । তিতাসের জলে অনেক মাছ । মালোর ছেলের স্ফূর্তি রসাইয়া উঠে । জালের দিকে চোখ রাখিয়াই গাহিয়া উঠে, ‘আগে ছিলাম ব্রাহ্মণের মাইয়া করতাম শিবের পূজা, জালুয়ার সনে কইরা প্রেম কাটি শণের সুতা রে, নছিবে এই ছিল ।’ বৌ ঠিক শুনিতে পাইবে ।
গ্রামের পর গ্রাম । নৌকাখানা সেখানে ঢুকিয়া পড়ে । সাপের জিহবার মত চকিতে সে-খাল গ্রামখানাকে ঘুরিয়া কোথায় পলাইয়া গিয়াছে । হয়ত আরো দূরে গিয়াছে । আরো কয়েকখানি গ্রামের পাশ দিয়া জের টানিতে টানিতে গিয়া, তারই কোনটাতে বৌকে লইয়া যাইবে । খালের পাড়েই বাড়ি । ছোট্ট ছেলে-পিলেরা তৈরি হইয়া আছে, বৌকে কি করিয়া চমকাইয়া দিবে । তৈরি হইয়া আছে হয়ত আরও কেউ । খালটা এইখানে শুকাইয়া গিয়াছে । এইখানে নৌকা হইতে উঠিয়া বৌকে খানিকটা হাটিয়া যাইতে হইবে । শিল্পী শান্ত সবুজ সুন্দর রঙে ক্ষেতগুলির বুকে-বুকে যে নক্সা আঁকিয়া রাখিয়াছে তাহারই আল দিয়া বৌকে হাটিতে হইবে । তিতাসের তীরে না থাকার কি কষ্ট । যে-বউয়ের যাওয়ার বাড়ি একেবারে তিতাসের তীরে, কর্ম-চঞ্চল ঘাটখানাতে তার নৌকা লাগে । দশ-জোড়া নারীর চোখের দবদে স্নান করিয়া সে বৌ নৌকা থেকে নামে । তারপর বাপের বাড়ি হইলে এক দৌড়ে ঘরে ঢুকিয়া ছোট ছোট ভাইবোনদের বুকে চাপিয়া ধরে । আর স্বামীর বাড়ি হইলে পিঠের কাপড় সুদ্ধ টানিয়া তুলিয়া ঘোমটা বড় করে, তারপর আগে-পিছে দুই-চারিজন নারীর মাঝখানে থাকিয়া ধীরে ধীরে জড়িত পায়ে ঘাটের পথটুকু অতিক্রম করে ।