তিতাসের তেরো মাইল দূরে এমনি একটা নদী আছে । নাম বিজয় নদী । তিতাসের পারের জেলেদের অনেক কুটুম বিজয় নদীর পারের পাড়াগুলিতে আছে । তিতাসের পারের ওরা ওই নদীর পারের কুটুম-বাড়িতে অনেকবার বেড়াইতে গিয়াছে । বিয়ের কনের খোঁজে গিয়াছে । সে-সব গাঁয়ে তারা দেখিয়াছে, চৈত্রের খরায় নদী কত নিষ্করুণ হয় । একদিক দিয়া জল শুকায় আর একদিক দিয়া মাছেরা দমবন্ধ হওয়ার আশঙ্কায় নাক জাগাইয়া হাঁপায় । মাছেদের মত জেলেদেরও তখন দম বন্ধ হইতে থাকে । সামনে মহাকালের শুষ্ক এক কঙ্কালের ছায়া দেখিয়া তারা একসময় হতাশ হইয়া পড়ে । যারা বর্ষার সময় চাঁদপুরের বড় গাঙ্ এ নৌকা লইয়া প্রবাস বাহিতে গিয়াছিল, তারা সেখানে নিকারীর জিম্মায় নাও জাল রাখিয়া রেলে চড়িয়া আসিয়া পড়ে । তাদের কোন চিন্তা থাকে না । হাতের টাকা ভাঙিয়া এই দুর্দিন পার করে । কিন্তু যারা বর্ষায় ঘরের মায়া ছাড়িয়া বাহির হয় নাই তারাই পড়ে বিপদে । নদী ঠন্ ঠনে । জাল ফেলিবে কোথায় । তিন-কোণা ঠেলা-জাল কাঁধে ফেলিয়া আর-এক কাঁধে গলা-চিপা ডোলা বাঁধিয়া এ-পাড়া সে-পাড়ায় টই-টই করিয়া ঘুরিতে থাকে, কোথায় পানা পুকুর আছে মালিক হীন ছাড়া বাড়িতে । চার পারে বন বাদাড়ের ঝুপড়ি । তারই ঝরাপাতা পড়িয়া, পচিয়া, ভারি হইয়া তলায় শায়িত আছে । তারই উপর দিয়া ভাসিয়া উঠিয়া ছোট মাছেরা ফুট দেয় । গলা-জল শুকাইয়া কোমর-জল, কোমর-জল শুকাইয়া হাঁটু-জল হইয়াছে । মাছেদের ভাবনার অন্ত নাই । কিন্তু অধিক ভাবিতে হয় না । গোপালকাছা-দেওয়া দীর্ঘাকার মালো কাঁধের জল নামাইয়া শুন্য-দৃষ্টিতে তাকাইতে তাকাইতে এক সময় খেউ দিয়া তুলিয়া ফেলে । মাছেদের ভাবনা এখানেই শেষ হয়, কিন্তু মাছ যারা ধরিল তাদের ভাবনার আর শেষ হয় না । তাদের ভাবনা আরও সুদূর-প্রসারী । সামনের বর্ষাকাল পর্যন্ত ।
বর্ষাকালের আর খুব বেশি দেরি নাই । সঙ্কট অবসানের সম্ভাবনায় অনেক মালো উদ্বেগের পাহাড় ঠেলিয়া চলিয়াছে, হাতে ঠেলা-জাল লইয়া চুনো-পুঁটি যা পায় ধরিয়া পোয়া দেড়-পোয়া চাউলের যোগাড় করিতেছে । কিন্তু গৌরাঙ্গ মালোর দিন আর চলিতে চায় না । একদিন অনেক খানাডোবায় খেউ দিয়া কিছুই পাইল না, নামিলে টগবগ করিয়া পচা জলের ভুরভুরি উঠে, আর খেউ দিলে তিনচারিটা ব্যাঙ্ জাল হইতে লাফাইয়া এদিকে ওদিকে পড়িয়া যায় ।
উঠানের একদিকে একটা ডালিম গাছ । পাতা শুকাইয়া গিয়াছে । গৌরাঙ্গসুন্দরের বউ লাগাইয়াছিল । বউ যৌবন থাকিতেই শুখাইয়া গিয়াছিল । গাল বসিয়া, বুক দড়ির মত সরু হইয়া গিয়াছিল । বুকের স্তনদুটি বুকেই বসিয়া গিয়াছিল তার । তারপর একদিন সে মরিয়া গিয়াছিল । সে মরিয়া গিয়া গৌরাঙ্গকে বাঁচাইয়াছে । তার কথা গৌরাঙ্গসুন্দরের আর মনে পড়ে না । তারই মত শুকাইয়া-যাওয়া তারই হাতের ডালিম গাছটা চোখে পড়িতে আজ মনে পড়িয়া গেল । উঃ, বউটা মরিয়া কি ভালই না করিয়াছে ! থাকিলে, আজ তার অবস্থা হইত ঠিক নিত্যানন্দদাদার মত ।
নিত্যানন্দ থাকে উত্তরের ঘরে । তার বউ আছে । আর আছে একটি ছেলে, একটি মেয়ে । নিত্যানন্দ-পরিবারের দিকে চাহিয়া গৌরাঙ্গ শিহরিয়া উঠে ! একপেটের ভাবনা নিয়াই বাঁচি না, দাদা চারিটা পেটের ভাবনা মাথায় করিয়া কেমন তামাক খাইতেছে । তার যেন কোন ভাবনাই নাই ।
সত্যি নিত্যানন্দের আর কোন ভাবনা নাই । যতই ভাবিয়াছে, দেখিয়াছে কোন কূল-কিনারা পাওয়া যায় না । বৌ ঝিমাইতেছে । ছেলেমেয়ে দুইটা নেতাইয়া পড়িয়া কিসের নির্ভরতায় অক্ষম নিত্যানন্দের মুখের দিকে চাহিয়া আছে । আর নিত্যানন্দ কোন উপায় না দেখিয়া কেবল তামাক টানিতেছে ।
পশ্চিমের ভিটায় গৌরাঙ্গসুন্দরের ঘর । ডালিম গাছে কাঁধের জাল ঠেকাইয়া দিয়া ডোলাটা ছুঁড়িয়া ফেলিল দাওয়ার একদিকে । দক্ষিণ ও পূর্বদিকের ভিটা খালি । তাদের দুই কাকা থাকিত । এক কাকা মরিয়া গিয়াছে এবং তার ঘর বেচিয়া তার শ্রাদ্ধ করিতে হইয়াছে । আরেক কাকা ঘর ভাঙিয়া লইয়া আরেক গাঁয়ে ছাড়িয়া গিয়াছে ।
গৌরাঙ্গ অকারণে খেঁকাইয়া উঠিল, ‘খালি তামুক খাইলে পেত ভরব ?’
‘কি খামু তবে ?’
না, লোকটার কেবল পেটই শুকায় নাই । মাথাও শুকাইয়া গিয়াছে ।
‘চল যাই বুধাইর বাড়ি ।’
নয়ানপুরে বোধাই মালো টাকায় সব মালোদের চেয়ে বড় । বাড়িতে চার পাঁচটা ঢেউটিনের ঘর । দুই ছেলে রোজগারী লোক । বোধাই হাতীর মত মোটা ও কাল । শরীরেও হাতীর মত জোর । তার কারবার অন্য ধরণের । বড় বড় দীঘি ইজারা নিয়া মাছের পোনা ফেলে । মাছ বাড়িতে থাকে, আর তারা তিন বাপ বেটায় লোকজন লইয়া জাল ফেলে, মাছ তোলে, মাছ চালান দেয় । এ কাজে বোধাই অনেক লোকজন খাটায় । নদীতে জল না থাকিলে, মালোরা যখন দুই চোখে অন্ধকার দেখে তখন তারা যায় বোধাইর বাড়িতে ।
কিন্তু তিতাসে কত জল ! কত স্রোত ! কত নৌকা ! সব দিক দিয়াই সে অকৃপণ ।
আর বিজয়-নদীর তীরে-তীরে যে-মালোরা ঘর বাঁধিয়া আছে, তাদের কত কষ্ট । নদী শুকাইয়া গেলে তাদের নৌকা-গুলি অচল হইয়া থাকে আর কাঠ-ফাটা রোদে কেবল ফাটে ।
তিতাস-তীরের মালোরা যারা সেখানে বেড়াইতে গিয়াছে, চৈত্রের খরায় নদী কত নিষ্করুণ হয় দেখিয়া আসিয়াছে । রিক্ত মাঠের বুকে ঘূর্ণির বুভুক্ষা দেখিতে দেখিতে ফিরতি-পথে তারা অনেকবার ভাবিয়াছে, তিতাস যদি কোনোদিন এই রকম করিয়া শুকাইয়া যায় ! ভাবিয়াছে এর আগেই হয়ত তাদের বুক শুকাইয়া যাইবে , ভাবিতে ভাবিতে হঠাৎ পাশের জনকে নিতান্ত খাপছাড়াভাবে বলিয়াছেঃ ‘বিজ্ নার পারের মালোগুষ্টি বড় অভাগা রে ভাই, বড় অভাগা !’