পরদিন তারা এখান হইতে নৌকা খুলিল। ছপ্ ছপ্ ছলাৎ শব্দ করিয়া নৌকা দুই তরুণের দাড়ের টানে ঢেউ ভাঙিয়া আগাইয়া চলিল। তীরে দাঁড়াইয়া সাধু। নৌকা যতই দূরে যাইতেছে, তার দুই চোখ জলে ভরিয়া উঠিতেছে। তার কেউ নাই। সকলের মধ্যে থাকিয়াও সে একা। তারা আনন্দ করিতে জানে না, আনন্দ দিতে জানে না। যারা আনন্দ দিতে পারিল, তাকে একটানা দৈনন্দিনতার মধ্যে ফেলিয়া তারা ঐ দূরে সরিয়া যাইতেছে।
অকূল মেঘনার অবাধ জলরাশির উদার শুভ্র বুকের উপর একটি কালো দাগের মতো ছোট হইতে হইতে তারা এক সময় মিলাইয়া গেল।
সাধুর বুক ছাপাইয়া বাহির হইল একটি দীর্ঘশ্বাস। তারা দিয়া গেল অনেক কিছু, কিন্তু নিয়া গেল তার চাইতেও অধিক।
এইখানে পাড়াটা ধনুকের মত বাঁকিয়া গিয়াছে। বাঁকা অংশ জুড়িয়া স্রোতের আবর্ত এত জোরে পাক খাইয়া চলিতেছে যে, তীরে লাগিয়া অমন শক্ত মাটিকেও যেন করাত-কাটা করিতেছে, ছিন্নমূল তালগাছের মত ভাঙ্গিয়া ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে এক একটা অতিকায় মাটির ধস। ভাঙ্গনের এই সমারোহে পড়িয়া পাড়াটা খাড়া উঁচু হইয়া উথিয়াচে। দেখিলে ভয় হয়! ইহার নিকট দিয়া নৌকা চালাইতে বিপদের আশঙ্কা আছে। যদি একটি ধ্বস ভাঙ্গিয়া নৌকার উপরেই পড়ে। যা স্রোত! আগানো বড় কঠিন। তবু আগাইতে হইবে।
সকাল হইতে নৌকা বাহিয়া সুবল দুপুরে খাইয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। একটানা রাতের-জালে যাওয়ার এমনি অবভাশ। জালে না গেলেও রাতে চোখে ঘুম আসে না। দুপুরে চোখে ঘুম আসে, ঘুমাইতে হয়। তিলক সে কাজ দুপুরের আগেই সারিয়াছে। হুকা হাতে শুইয়া ছিল। হাতের হুকা হাতেই ছিল। দেখিয়া মনে হইয়াছিল যেন চাহিয়াই আছে। চোখ খলা। অথচ এরই মধ্যে ঘুমাইয়া নিয়াছে। এখন গলুইয়ে বসিয়া ঝপাঝপ দাঁড় ফেলিতে ফেলিতে জলের দিকে চাহিয়া বলিল, ‘এইবার যা মাছ পরব কিশোর! জলের রূপখান চাইয়া দেখ্ ।’
মেঘনার বিশালতা এখানে অনেক কমিয়া গিয়াছে। ভাঁটিতে থাকিতে এপার হইতে ওপার একটা রেখার মতো দেখা যাইত। এখন উজানে আসিয়া, এপারে থাকিয়া ওপারের খড়ের ঘরগুলি পর্যন্ত সুস্পষ্ট দেখা যাইতেছে।
বিকালে ঘুম ভাঙ্গিয়া উঠিয়া সুবল অবাক হইল।
‘তিলক, ইটা কোন্ গাঙ্?’
‘কোন্ গাঙ্ আবার । যে-গাঙ্ দিয়া আসা অইসে।’
‘ইখানে মেঘনা অত ছোট?’
‘যত উজানে যাইবা ততই ছোট।’
‘আরো কত উজানে যাইতে হইব? উজানি-নগরের খলা আর কতদূর? শুকদেবপুরের বাঁশিরাম মোড়লের বাড়ি আর কতদুর?’
‘আবার ঘুমাইয়া থাক। একেবারে তাঁর ঘাটে নাও ভিড়াইয়া ডাক দিমু, হুক্কা হাতে লইয়া।’
‘যাও আর ঠিসারা কইর না।’
দূরে একখানা ছায়াচ্ছন্ন পল্লী। গাছপাতায় সবুজ। তাকে পাশে রাখিয়া যেন অকস্মাৎ নদী টানা ধনুকের মত বাঁকিয়া সোজা পশ্চিমের দিকের অদৃশ্য হইয়াছে। পশ্চিম পারের আড়ালে পড়ায় এখান হইতে তাকে আর দেখা যাইতেছে না। বাঁকানো ঢালা পার। পড়ন্ত রোদে তার বালিরাশি চিকচিক করিতেছে। সেই বালিঢালা পারের উপর একস্থানে দশ-বারখানি বড় বড় খড়ের ঘর। গাছপালা একটিও নাই; কোনোখানে সবুজের চিহ্নমাত্র নাই। কেবল বালি আর কয়েকখানা ঘর-মরুর বালুকায় পান্থ-নিবাসের মত। ব্যতিক্রম কেবল সচল অজগরের মত এলাইয়া পড়া নদীটি।
আরো একটু স্পষ্ট হইয়া উঠিলে তিলক তার বৃদ্ধ চক্ষু দুইটির প্রতি অসীম করুণায় কিঞ্চিৎ আবেগের সঙ্গে বলিল, ‘ঐ দেখা যায় শুকদেবপুর আর ঐ উজানিনগরের খলা।’
কিশোর আর কোন কথা বলিল না। যেখানটার পরে নদী আর দেখা যাইতেছেনা সেই দিকে চাহিয়া রহিল।
বাঁশিরাম মোড়লের ঘাটে যখন নৌকা ভিড়িল, তখন সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে।
মোড়ল খুব প্রতাপশালী লোক। এখানে নদীর পাঁচ মাইল তার শাসনে। এখানে মাছ ধরিতে হইলে তাঁরই সঙ্গে বন্দোবস্ত করিতে হয়।
পরদিন সকালে মোড়লের বাড়ি হইতে নিমন্ত্রণ আসিল, দুপুরে তাঁর বাড়িতে সেবা করিতে হইবে।
দুপুরে স্নান করিয়া তিনজনে সেখানে উপস্থিত হইল।
মোড়লের বাড়িতে চার ভিটাতে চারিটি খড়ের ঘর। সংস্কারাভাবে জীর্ণ। তারই একটার বারান্দায় বসিয়া সে এক বাক্স রূপার টাকা গুনিতেছে। তার শরীর পাথরের মত নিরেট, অসুরের মত শক্ত। রঙ কালো। বয়স পঞ্চাশের উপর। কিন্তু মাংসে চামড়ায় বার্ধক্য ধরে নাই। কণ্ঠার দুইপাশের মোটা হাড়ে অজস্র দৈহিক বলের পরিচয়। কিশোর মনে মনে বলিল, ‘তোমার মত মুনীসের পঁচিশটায় শ’। তোমার চরণে দণ্ডবৎ।’
মোড়ল তার নূতন জেলেদিগকে অভ্যর্থনা করিয়া বসাইল।
‘নাম ত জানলাম কিশোর। পিতার নাম ত জানলাম না।’
‘পিতার নাম রামকেশব।’
‘হ, চিনতে পারছি। তোমরা ক’ ভাই।
‘ছোট এক ভাই আছিল; মারা গেছে। অখন আমি একলা।’
‘পুত্রসন্তান কি?’
‘আমার পুত্রসন্তান আমিই।’
‘হ, বুঝলাম। বিয়া করছ কই?’
কিশোর চুপ করিয়া রহিল। কথা বলিল সুবল। এইবার দেশে গিয়া করিবে। সম্বন্ধ নিজ গ্রামেই ঠিক হইয়া আছে।
রান্না যা কিছু হইয়াছে সবই বড়মাছের। কিশোরেরা ছোট মাছের জেলে। বড়মাছ বড় একটা মুখে পড়ে না, কেন না এ সব মাছ তারা ধরিতে পারে না। কোনোদিন কোনো বড় মাছ পথ ভুলিয়া তাদের জালে আসিয়া পড়িলেও পয়সার জন্য বেচিয়া ফেলিতে হয়।
মোড়ল খায় যেমন বেশি খাওয়ার উপর তার মনোযোগও তেমনি অখণ্ড। খাওয়ার ফাঁকে একবার তার অতিথিদের কথা মনে পড়িল।
‘জাল্লা ভাই, যা খাইবা কেবল হাতের জোরে।’
কিশোর কোন উত্তর দিতে পারিল না। কারণ আয়োজনের এত প্রাচুর্যের মধ্যে পড়িয়া তার খুব লজ্জা করিতে লাগিল। রুইমাছের মাথার খানিকটা চিবাইতে চিবাইতে উত্তর দিল তিলক, ‘কি যে তুমি কও মোড়ল।’