‘আমার হুক্কাও আইতাছে। দেও আগে তোমারটাই খাঁই।’
এই সময়ে একটি ছোট দিগম্বরী হৃষ্টপুষ্ট মেয়ে আসিতেছে দেখা গেল। বাড়ি থেকে হুক্কা লইয়া আসিয়াছে। শরীরের দুলানির সঙ্গে সঙ্গে হুক্কাটা ডাইনে-বাঁয়ে দুলিতেছে। নৌকার কাছে আসিয়া ডাকিল, ‘বাবু, আমারে তোল্ ।’
মেয়ের হাত হইতে হুক্কা লইয়া কিশোরের দিকে বাড়াইয়া লোকটি বলিল, ‘আমি খাই তোমার হুক্কা, তুমি খাও আমার ঝিয়ের হুক্কা। – আমার ঝি।’
মেয়ের দিকে চাহিয়া বলিল, ‘কি গো মা, জামাই দেখছ নি! বিয়া দিয়া দেই?’
‘কার ঠাঁই?’
এই বুড়ার ঠাঁই।’
‘ননা, বুড়ার ঠাঁই না। আমার জামাই হইব যবুনার জামাইর মত সুন্দর। মায় কইছে।’
‘তা অইলে এই জামাইর ঠাঁই দেই?’
কন্যাকর্তা সুবলের দিকে হাতের তকলি বাড়াইল। সুবল কিশোরের দিকে চাহিয়া মুচকিয়া হাসিল।
‘নাও লইয়া আইছ, নিয়া যাইবার বুঝি?’
সুবল বলিল, ‘হ, লইয়া যামু অনেক দূর। এই দেশের কাওয়ার মুখও দেখতে পারবা না।’
মেয়ের চিন্তিত মুখ দেখিয়া বাপের দয়া হইল, ‘না না আমার মায়েরে যাইতে দিমু না। জামাই আমরা ঘর-জামাই রাখুম।’
বাড়ি যাইবার সময় লোকটি কিশোরকে বলিয়া গেল, ‘শোন মালোর পুত, তোমরার পাক আমার বাড়িতে হইব। আমার ঝি তোমরারে নিমন্তন করল। – কি কও?’
‘না না আমরা নাওই রান্ধুম। তুমি খাও গিয়া। রাইতের জালে যাও বুঝি।‘
‘ইখানে রাইতের জাল বাওন লাগে না। বেহানে কটা বিকালে কটা খেউ দিলেই হয়। অদৈন্য মাচ। কত মাছ ধরবায় তুমি।’
লোকটি মেয়েকে স্নান করাইল, নিজে স্নান করিল, গামছা পরিয়া কাপড় নিংড়াইয়া কাঁধের উপর রাখিল। তারপর মেয়েকে কোলে তুলিয়া গ্রামপথে পা বাড়াইল। কিশোরের চোখে ভাসিয়া উঠিল সুন্দর একটি পরিবারের ছবি, যে-পরিবারে একটি নারী আছে একটি নন্দিনী আছে, আর পুরুষকে সারারাত নদীতে পড়িয়া থাকিতে হয় না। তার মনে একটা ঔদাস্তের সুর খেলিয়া গেল। নির্লিপ্তকণ্ঠে বলিল, ‘কইরে সুবলা, কি করবে কর। – নাও ভাসাইয়া দিমু।’
কিছুই করিতে হইল না। গলায় মালা কপালে তিলক একজনকে পল্লীপথে বাহির হইয়া আসিতে দেখা গেল। তার মুখময় হাসি। কোনো ভূমিকা না করিয়াই বলিল, ‘দেখ মালোর পুত। দোহাই তোমার দোহাই তোমার বাপের। আমার ঘাটে যখন নাও লাগাইছ, সেবা না কইরা যাইতে পারবায় না।’
সবল তার কথা বলার ভঙ্গী। প্রত্যেকটি কথা আত্ম-প্রত্যয়ে সুদৃঢ়। কিশোরের মৃদু প্রতিবাদ তৃণের মতো উড়িয়া গেল।
খাইতে বসিলে, সেই নন্দিনী-গর্বিত পাত্রান্বেষী লোকটি বলিল, ‘এ-ই। তখনই আমি মনে করছিলাম, আমার হাতে ছাড়া পাইলেও সাধুর হাতে ছাড়ান নাই। তাই ঘাটে কিছু না কইয়া জানাইয়া দিলাম সাধুরে।’
খাওয়ার পর সাধু ধরিল, আজ রাতটুকু থাকিয়া যাও। একটু আনন্দ করিবার বাসনা হইয়াছে।
তিলক বলিল, ;আমরা ত বাবা গান জানি না।’
‘জান না! কোন্ জায়গাতে বিরাজ কর তোমরা?’
‘গ্রামের নাম গোকনঘাট – ’
‘আমি সেই কথা কই না। আমি কই, তোমরা বিরাজ কর বৃন্দাবনে না কৈলাসে – তোমরা কৃষ্ণমন্ত্রী না শিবমন্ত্রী।’
তিলকের সেই কোন যৌবনকালে গুরুকরণ হইয়াছিল। গুরু তার কানে কৃষ্ণমন্ত্রই দিয়াছে। যদিও সে দীক্ষা অনুযায়ী কোন কাজই আজ পর্যন্ত করিয়া উঠিতে পারিল না, তবু গুরুর তিন আখরের মূলমন্ত্র ভোলে নাই। সাধুর প্রশ্নে সে একটুও ইতস্তত না করিয়াই বলিল, ‘আমরা বাবা কিষ্ণমন্ত্রী ।’
‘এই দেখ, গুরু মিলাইছে। আনন্দ করার গানে ত জানা-অজানার কথা উঠে না বাবা, কেবল নামের রূপ-মাধুরী পান করতে হয়। ষোল নাম বত্রিশ আখরের মাঝে প্রভু আমার বন্ধন-দশায় আছে। শাস্ত্রে কয় বৃন্দাবনে অপ্রাকৃত মদনমোহন। বিবর্তবিলাসের কথা। সে হইল নিত্য-বৃন্দাবনের কথা। তিনি লীলা-বৃন্দাবনে আইসা সুবলাদি সখা আর ললিতাদি সখিসহ আদ্যাশক্তি শ্রীমতী রাধিকারে লইয়া লীলা কইরা গেছে। সেই লীলা-বৃন্দাবনে অখন আর তানরা নাই। আছেন নিত্য-বৃন্দাবনে। সেই নিত্য-বৃন্দাবন আছে এই দেহেরই মধ্যে। তবেই দেখ-তানরা এই দেহের মধ্যেই বিরাজ করে। তারপর নদীয়া নগরের প্রভু গৌরাঙ্গ-অবতারের কথাখান ভান না কেনে। পদকর্তা কইচেঃ আছে মানুষ গ সই, আছে মানুষ গওরচান্দের ঘরে, নিগুঢ় বৃন্দাবনে গ সই, আছে মানুষ।। এক মানুষ বৈকুণ্ঠবাসী, আরেক মানুষ কালোশশী, আরেক মানুষ গ’ সই, দেহের মাইঝে রসের কেলি করে – নিগুঢ় বৃন্দাবনে গ সই আছে মানুষ ।।’
কথাগুলির অর্থ তিলক কিছু কিছু বুঝিল। কিশোর ও সুবল মুগ্ধ আনুগত্যের দৃষ্টি দিয়া। বক্তার কথাগুলি উত্তমরূপে শুনিয়া লইয়া মনে মনে বলিল, এসব তত্ত্বকথা, অত্যন্ত শক্ত জিনিস। যে বুঝে সেই স্বর্গে যায়। আমি তুমি পাপী মানুষ। আমরা কি বুঝিব!
অনেক রাত পর্যন্ত গাল হইল। সাধু নিজে গাহিল। পাড়ার আরো দু’চারজন গাহিল। তিলকও তাহার জানা ‘উঠান-মাটি ঠনঠন পিড়া নিল সোতে, গঙ্গা মইল জল-তিরাসে ব্রহ্মা মইল শীতে’,গানটি গাহিল। সাধুর নির্বন্ধাতিশয্যে কিশোর আর সুবল দুইজনে তাহাদের গাঁয়ের সাধুর বৈঠকে শোনা দুই-তিনটা গান গাহিয়া সাধুর চোখে জল আনিল।
তাদের গান শুনিয়া-সাধু মুগ্ধ হইল। ততোধিক মুগ্ধ হইল তাদের সরল সাহচর্যে । মনে মনে বলিলঃ বৃন্দাবনের চির কিশোর তোমরা, কৃষ্ণে তোমাদের গোলকের আনন্দ দান করুক। আমাকে যেমন তোমরা আনন্দ দিলে তোমরাও তেমনি আনন্দময় হও।