বন্দরের কলরব ধীরে ধীরে পশ্চাতে মিলাইয়া গেল। সম্মুখে বিরাট নদী তার বিশালতা লইয়া চুপ করিয়া পড়িয়া আছে। শীতের নদী। উত্তরের হাওয়া সরিয়া গিয়াছে। দক্ষিণের বাতাস এখনো বাহির হয় নাই! নদীতে ঢেউ নাই, স্রোতের বেগও নাই। আছে কেবল শান্ত তৃপ্ত স্বচ্ছ অবাধ জলরাশি। এই অনন্তের ধ্যান ভাঙিয়া, এই প্রশান্তের মৌনতা বিঘ্নিত করিয়া কিশোরের নৌকার দুইখানা দাঁড় কেবল উঠানামা করিতেছে।
এতক্ষণ কূল ঘেঁষিয়া চলিতেছিল। ঢালা বালিরাশির বন্ধ্যা কূল। লোকের বসতি নাই, গাছপালা নাই, ঘাট নাই। কোনোখানে একটি নৌকার খুঁটিও নাই। এমনি নিষ্করুণ নিরালা কূল। রোদ চড়িলে, শীত অন্তর্হিত হইল। সুদূরের ইশারায় এই নির্জনতার মাঝেও কিশোরের মনে যেন আনন্দের ঢেউ উঠিল। নদীর এই অবাধ উদার রূপ দেখিতে দেখিতে অনেক গানের সুর মনে ভাসিয়া উঠিল। অদূরে একটা নৌকা। এদিকে আসিতেছে। কিশোর গলা ছাড়িয়া জুড়িল –
উত্তরের জমিনে রে, সোনা-বন্ধু হাল চষে,
লাঙ্গলে বাজিয়া উঠে খুয়া।
দক্ষিণা মলয়ার বায় চান্দমুখ শুকাইয়া যায়,
কার ঠাঁই পাঠাইব পান গুয়া।
নৌকাটা পাশ কাটাইবার সময় তারা কিশোরের গানের এই পদটি শুনিল –
নদীর কিনার দিয়া গেল বাঁশি বাজাইয়া,
পরার পীরিতি মধু লাগে।
কু-খেনে বাড়াইলাম পা’ খেয়াঘাটে নাইবে না,
খেয়ানীরে খাইল লঙ্কার বাঘে।
একজন মন্তব্য করিল, ‘বুড়ারে দাঁড় টানতে দিয়া জোয়ান বেটা খাড়ইয়া রইছে, আবার রস কেমুন, পরার পীরিতি মধু লাগে।’
কিশোর আঘাত পাইয়া বলিল, ‘যাও তিলকচাঁদ, তুমি গিয়া ঘুমাইয়া থাক।’
তিলক নৌকার মালিকের আদেশ অগৌণে পালন করিল।
আবার নির্জনতা। যত দূর চোখ যায়, শুধু জল।
দাঁড়ের উপর মনের ঢালিয়া কিশোর বলিল, ‘বা’র গাঙ্ দিয়া ধরত দেখি সুবলা। খালি বালু দেখতে এর ভাল লাগেনা। ধর্ কোণাকুনি ধর্। পার বাইবি ত অই পার দিয়া ধর্। এই পারে কিচ্ছু নাই।’
কিন্তু ও-পার তখনো চোখের আড়ালে। যা দৃষ্টির বাহিরে, তারই হাতছানির মায়ায় তারা বিপদে পা দিল। কিশোরের বুক একবার একটু কাঁপিয়াছিল একটা গান মনে পড়িয়া ‘মাঝিভাই তোর পায়ে পড়ি, পার দেখিয়া ধর পাড়ি।’ কিন্তু শেষের কথাগুলি সুন্দর, ‘পিছের মাঝি ডাক দিয়া কয় নৌকা লাগাও প্রেম-তলায়। হরি বল তরী খুল সাধের জোয়ার যায়।’ কিশোর নিজের মনকে প্রবোধ দিল, বৈঠার আওয়াজ বেসুরা হইতেছে দেখিয়া সুবলকেও সাহস দিল, ‘না সুবলা, ডরাইসনা। গাঙের ডর মাইঝ গাঙে না, গাঙের বিপদ পারের কাছে। বা’র গাঙে মা-গঙ্গা থাকে, বিপদে নাইয়ারে রক্ষা করে।’
চিলকচাঁদের ঘুম ভাঙ্গিল। বাহিরে আসিয়া দেখে বেলা নাই। নৌকার লক্ষ্য যে তীরের দিকে, সে-তীরের ভরসা নাই, পশ্চাতে ফেলিয়া আসিয়াছে যে তীর, তারও ভরসা নাই।
শীতের বেলা ফুরাইল ত একেবারেই শেষ হইয়া গেল। নদীর উপর যাও বা একটু আলো ছিল তাও অদৃশ্য হইল। তারপর তারা কুলহারা হইয়া কেবল মেঘনার বুকেই নিরুদ্দেশ হইল না, আঁধারের বুকেও আত্মসমর্পণ করিল।
সুবল বৈঠা রাখিয়া ছইয়ের ভিতর আসিল, টিমটিমে একটা আলো তিলক জ্বালাইয়াছিল, সেটা রাগ করিয়া নিভাইয়া ফেলিল। তিলক তামাক টানিতেছিল, সেটা একটানা টানিয়া চলিল। শুধু কিশোর নিরাশ হইল না। সুবলের পরিত্যক্ত হালখানা হাতে লইয়া জোরে কয়েকটা টান দিল। হঠাৎ নৌকাটা কিসের উপর ঠেকিল, ঠেকিয়া একেবারে নিশ্চল হইয়া গেল। আতঙ্কিত হইয়া তিলক বলিয়া উঠিল, ‘আর আশা নাই সুবলা, কুমীরের দল নাও কান্ধে লইছে।’
‘আমার মাথা হইছে। নাও আটকাইছে চরে। বাইর অইয়া দেখ না।’
বাহির হইয়া দেখিয়া তিলক বলিল, ‘ইখানে পাড়া দে।’
রাত পোহাইলে দেখা গেল এখানে নদীর বুকে একটুখানি চর জাগিয়াছে, তারই উপরে লোকে নানা জাতের ফসল বুনিয়াছে। চারাগুলিতে ফুল ধরিয়াছে। পাখ্ পাখালিরাও খোঁজ পাইয়া সকাল বেলাতেই বসিয়া গিয়াছে। মেলার মতো।
ভোরের রোদে নৌকা খুলিয়া দুপুর নাগাদ অনেক পথ আগাইয়া তারা পূবপার ধরিল। ঘাটে নৌকা বাঁধা, পারে জাল টাঙানো – সেখানেও এক মালো পাড়া।
‘চিন নি চিলক, ইটা কি গাঁও?’
তিলক চিনিতে পারিলনা।
‘ইখানেই নাও, রাখ্ সুবলা। দুপুরের ভাত ইখানেই খাইয়া যাই।’
‘হ, খাওয়াইবার লাইগ্যা তারা তৈয়ার হইয়া রইছে।’
‘ভাত খামু নিজে রাইন্ধা, পরের আশা করি নাকি?’
ঘাটে সারি সারি নৌকা বাঁধা। তারই একটার পাশে সুবলা নৌকা ভিড়াইল।
একজন নৌকায় বসিয়া ছেঁড়া জাল গড়িতেছিল। কৌতূহলী হইয়া আগন্তুক-নৌকার দিকে তাকাইল। মালোদের নৌকা, দেখিলেই চেনা যায়। ভিড়িতেই, কোন্ গ্রামের নৌকা, কথায় যাইবে জিজ্ঞাসা করিল।
তারাও জিজ্ঞাসা করিয়া জানিল, গ্রামের নাম নয়াকান্দা। ত্রিশ-চল্লিশ ঘর মালো থাকে। নয়া বসতি করিয়াছে। আগে ছিল পশ্চিম পারের এক শিক্ষিত লোকের গ্রামে। নদীর পারে যেখানে তারা নৌকা বাঁধিত জাল ছড়াইত, জমিদার সে-জমি তাদের নিকট হইতে জোর করিয়া ছিনাইয়া অন্য জাতের কাছে বন্দোবস্ত দিয়াছে। তাই তারা সেই অবিচারের গ্রাম ছাড়িয়া এখানে আসিয়া নূতন বাড়ি বাঁধিয়াছে। এখানে জমিদার নাই। বেশ শান্তিতে আছে। হাটবাজার দূরে। কিন্তু ঘাটে নৌকা আছে, দেহে ক্ষমতা আছে। তারা দূরকে সহজেই নিকট করিতে পারে।
কিশোর মুগ্ধ হইয়া শুনিতে শুনিতে হাতের হুক্কা তার দিকে বাড়াইয়া দিল।