তাহার হাতের কানি আঙ্গুলে ক্ষীর জড়াইয়া এয়োরা বউয়ের মুখের কাছে ধরিল। বউ-এর কানি আঙ্গুলে ক্ষীর জড়াইয়া আবার আজাহেরের মুখের কাছে ধরিল। আশেপাশের মেয়েরা মিহি সুরে বিবাহের গান গাহিতে লাগিল :
ওদিকে সইরা বইস হারে দামান
আমার বেলোয়া বসপি তোমার বামেনারে।
কেমনে বসপি আমার বেলোয়া হারে দামান
তাহার সিন্তা রইছে খালি নারে।
দুলার মামু দৌড়াইয়া তখন বাইনা বাড়ি যায় নারে।
কেমনে বসপি আমার বেলোয়া হারে দামান
ও তার গায়েতে জেওর নাইরে।
দুলার চাচা দৌড়ায়া তখন
সোনারূ বাড়ি যায় নারে।
আজাহেরের মনের খুশীর নদীতে যেন সেই সুর তরঙ্গ খেলিতে লাগিল।
.
০৩.
নতুন বউ লইয়া আজাহের বাড়ি ফিরিল। বাড়ি বলিতে তাহার কিছু ছিল না। মোড়ল তাহার বাড়ির ধারেই একটি জায়গা আজাহেরকে ঘর তুলিতে অনুমতি দিয়াছিল। সেইখানে দো-চালা একখানা কুঁড়েঘর তৈরী করিয়া কোনমতে সে একটা থাকার জায়গা করিয়া লইয়াছিল। তারই পাশে ছোট্ট একখানা রান্নাঘর। বউ আনিয়া আজাহের সেই বাড়িতে উঠিল। পাড়ার ছেলেমেয়েরা দৌড়াদৌড়ি করিয়া বউ দেখিতে আসিয়া তার ছোট বাড়িখানা কলরবে মুখর করিয়া তুলিল। সেই কলরবে তরঙ্গে তরঙ্গে আজাহেরের অন্তরের খুশীর তুফান যেন উথলিয়া উঠিতে লাগিল। কিছুক্ষণ পরে গ্রামের লোকজন সকলেই চলিয়া গেল।
আজাহের উঠানে বসিয়া নীরবে হুঁকা টানিতেছিল আর সেই কার ধুয়ার উপরে মনে মনে তাহার ভবিষ্যৎ-জীবনের সুখকর ছবি অঙ্কিত করিতেছিল। সমস্ত বাড়িখানা নীরব। কিন্তু সকল নীরবতা ভঙ্গ করিয়া কে যেন তাহার চারিদিক বেড়িয়া খুশীর ঝাঁঝর বাজাইতেছিল। ঘরের এক কোণে একটা পুটলীর মত জড়সড় হইয়া বউটি বসিয়াছিল। কি করিয়া সে বউটির সঙ্গে কথা বলিবে ভাবিয়া পাইতেছিল না।
বেচারী আজাহের! কত মাঠের কঠিন বুক সে লাঙলের আঘাতে ফাড়িয়া চৌচির। করিয়াছে–কত দৌড়ের গরুকে সে হেলে-লাঠির আঘাতে বশে আনিয়াছে। কত দেশে-বিদেশে সে পৈড়াত বেচিয়া কত বড় বড় লোকের সঙ্গে কথা কহিয়াছে, কিন্তু যে তাহার সারা জীবনের সঙ্গী হইয়া তাহার ঘর করিতে আসিল, তাহার সঙ্গে কথা কহিতে আজাহেরের সাহসে কুলাইয়া উঠিতেছে না, কি করিয়া সে কথা আরম্ভ করে কোন কথা সে আগে বলে কিছুই তাহার মনে আসিতেছে না। বিবাহের আগে সে কত ভাবিয়া রাখিয়াছিল–বউ আসিলে এইভাবে কথা আরম্ভ করিবে। এইভাবে রসিকতা করিয়া বউকে হাসাইয়া দিবে কিন্তু আজ সমস্তই তাহার কাছে কেমন যেন ঘুলাইয়া যাইতেছে।
ভাবিতে ভাবিতে আজাহের ঘামিয়া গেল। উঠানের আমগাছটি হইতে একটা পাখি কেবলই ডাকিয়া উঠিতেছিল, বউ কথা কও, বউ কথা কও। এই সুর সমস্ত নীরব গ্রামখানির উপর ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হইয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল। চারিধারের ঘনবনের অন্ধকার ভেদ করিয়া ঝি ঝি পোকাগুলি সহস্র সুরে গান গাহিতেছিল, তাহারই তালে তালে বনের অন্ধকার পথ ভরিয়া জোনাকীর আলোগুলি দুলিয়া উঠিতেছিল।
অনেকক্ষণ নীরবে বসিয়া থাকিয়া আজাহের উঠিয়া আসিয়া ঘরে প্রবেশ করিল। কেরোসিনের প্রদীপটি কতকটা মান হইয়া আসিয়াছিল। আজাহের তাহার সলিতা একটু উস্কাইয়া দিল। তারপর ঘরের মধ্যে ছেঁড়া মাদুরটি বিছাইয়া তাহার উপর শততালি দেওয়া কথাখানা অতি যত্নের সঙ্গে বিছাইল। রসুনের খোসায় তৈরী ময়লা তেল লাগান বালিশটি এক পাশে রাখিল। তারপর বউটিকে আস্তে কোলপাথালী করিয়া ধরিয়া আনিয়া সেই বিছানার এক পাশে শোয়াইয়া দিল।
এবার আজাহের কি যে করে ভাবিয়া পায় না। বিছানার একপাশে সেই শাড়ী-আবৃত বউটির দিকে একদৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল। শাড়ীর ফাঁক দিয়া বউ-এর মেহেদী মাখান সুন্দর। পা-দুটি দেখা যাইতেছিল। তারই দিকে চাহিয়া চাহিয়া আজাহেরের সাধ মিটিতেছিল না। ঘোমটার তল হইতে বউটি যেন বুঝিতে পারিল তাহার পা দুইটির পানে একজন চাহিয়া আছে। সে তখন ধীরে ধীরে পা দুইটি শাড়ীর আঁচলে ঢাকিয়া লইল। তাহাতে বউ-এর সুন্দর হাত দুটি বাহিরে আসিল। আজাহের আস্তে আস্তে নিজের দু’খানা হাতের মধ্যে। সেই রঙীন হাত দুখানা লইয়া নীরবে খেলা করিতে লাগিল। শাড়ীর অন্তরাল হইতে মেয়েটির মৃদু নিশ্বাস লওয়ার শব্দ শোনা যাইতেছিল, তাহা যেন আজাহেরের সমস্ত দেহমন গরম করিয়া তুলিতেছিল।
ধীরে ধীরে আজাহের বউএর মাথার ঘোমটাটি খুলিয়া ফেলিল। কেরোসিনের প্রদীপটি সামনে ঘুরিয়া ঘুরিয়া জ্বলিতেছে। তার আলোয় বউ-এর রাঙা টুকটুকে মুখখানা দেখিয়া দেখিয়া আজাহেরের সাধ মেটে না। বউ যেন ঘুমেই অচেতন। আজাহের মুখোনিকে একবার এদিকে উল্টাইয়া দেখে আবার ওদিকে উলটাইয়া দেখে। বাহুখানি লইয়া মালার মত করিয়া গলায় পরে। চারিদিকে মৃত্যুর মত নীথর স্তব্ধতা। সম্মুখের এই একটি নারীদেহ যেন সহস্র সুরে আজাহেরের মনে বাঁশী বাজাইতেছিল। সেই দেহটি সারিন্দা, তাকে মনের খুশীতে নাড়িয়া চাড়িয়া আজাহের যেন মনে মনে কত শত ভাটিয়ালি সুরের গান আকাশে বাতাসে ছড়াইয়া দিতেছিল। সেই সুরে চারিদিকের স্তব্ধতা ভেদ করিয়া আজাহেরের অন্তরে ছবির পর ছবি ভাসিয়া উঠিতে লাগিল।
তাহার ছোট্ট উঠানটি ভরিয়া একটি রাঙা টুকটুকে বউ ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। তার রাঙা পায়ের ছাপের উপরে কে যেন কলমীর ফুল ছড়াইয়া যাইতেছে। পৌষ মাসের উতল বাতাসে বাড়ির কদম গাছটির তলায় একটি বউ ধান উড়াইতেছে। ঈষৎ বাঁকা হইয়া দুই হাতের উপর কুলাভরা ধানগুলিকে সে বাতাসে উড়াইয়া দিতেছে, হাতের চুড়ীগুলি টুং টুং করিয়া বাজিতেছে। চিটাগুলি উড়িয়া যাইতেছে, ধানগুলি লক্ষ্মীর মত বউ-এর পায়ের কাছে আসিয়া জড় হইতেছে! সুখের কথা ভাবিতে ভাবিতে আরো সুখের কথা মনে জাগিয়া ওঠে। প্রথম অঘ্রাণ মাসে নতুন ধানের গন্ধে গ্রাম ভরিয়া গিয়াছে। আঁটি ভরা গুচ্ছ গুচ্ছ লক্ষ্মী-শালি ধান মাথায় করিয়া আজাহের ঘরে ফিরিতেছে। বাড়ির বেকী বেড়াখানা ধরিয়া বউ তার পথের পানে চাহিয়া আছে। আজাহের আসিতেই বুকের আঁচল দিয়া বউ উঠানের কোণটি মুছিয়া দিল। সেইখানে ধানের আঁটি মাথা হইতে নামাইয়া ঘরের দাওয়ায় বসিয়া তামাক টানিতে টানিতে সে বউ-এর সঙ্গে দুই একটা সামান্য প্রয়োজনের কথা বলিতেছে।