এটা ঠিক, ইন্দ্রনাথ পাশে না দাঁড়ালে পুনেতে কোর্স করতে যাওয়া রণিতার পক্ষে আদৌ সম্ভব হত না। সুধাময়ীর প্রবল বাধা সত্ত্বেও তিনি ওকে পছন্দমতো কেরিয়ার গড়ে তুলতে দিয়েছেন। আসলে মেয়েদের সম্বন্ধে সুধাময়ীর ধ্যানধারণা অনেকটাই সেকেলে। মেয়েরা লেখাপড়া শিখুক, এটা তিনি অবশ্যই চান। তবে তারা সব কিছু ফেলে শুধু কাজকর্মে মেতে উঠুক, এ ব্যাপারে তাঁর মন একেবারেই সায় দেয় না। একান্তই যদি কিছু করতে হয় স্কুল-কলেজে পড়াক, বড় জোর কোনো অফিসে ভদ্র পরিবেশে দশটা-পাঁচটা চাকরি করুক। কিন্তু তাদের লক্ষ বা অভীষ্ট হবে ঘর-সংসার, স্বামী-সন্তান। মেয়েরা পুলিশ অফিসার হবে, ফিল্ম-মেকার হবে, প্লেন চালাবে, কাজের অছিলায় যেখানে খুশি ঘুরে বেড়াবে, যখন ইচ্ছা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে, যখন ইচ্ছা ফিরে আসবে–এসব তিনি একেবারেই পছন্দ করেন না। তাঁর ধারণায় পুরুষ পুরুষই, মেয়ে মেয়েই। কখনই তারা সমান হতে পারে না। শারীরিক মানসিক, সমস্ত দিক থেকেই তাদের অনেক তফাত। সারা পৃথিবী জুড়ে মেয়েরা ইদানীং বহু ব্যাপারেই যে পুরুষদের টেক্কা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সে সব উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেও তিনি দেখবেন না। লোহার ফ্রেমে আটা নিজের ভাবনা-চিন্তা ধ্যানধারণার বাইরে একটা পা-ও ফেলতে তিনি রাজি নন।
ইন্দ্রনাথ বলেন, আরে বাবা, বসবে বসবে। তুমি এত উতলা হচ্ছ কেন?
সুধাময়ী বলেন, হচ্ছি শখ করে। ছোটদার সম্বন্ধটা তো ভেঙে দিলে তোমার মেয়ে। তুমি যে বলেছিলে দুটি ভাল ছেলে আছে–
শশব্যন্তে ইন্দ্রনাথ বলেন, আছেই তো।
তুমি তাদের বাবা-মার সঙ্গে কথা বল।
বলব, নিশ্চয়ই বলব।
সত্যি বলবো তোমাকে তো পঁয়ত্রিশ বছর ধরে দেখছি। সুধাময়ীর কণ্ঠস্বর ক্রমশ তিক্ত হয়ে উঠতে থাকে, চিরটা কাল বনের মোষ তাড়িয়ে গেলে। নিজের ছেলেমেয়ে, ঘর-সংসারের দিকে যদি নজর থাকে!
সুধাময়ীর এই কথাগুলো শতকরা একশ ভাগ সত্যি। নিজের পড়াশোনা, লেখালিখি, ইউনিভার্সিটি, ছাত্রছাত্রী–এ সব নিয়েই এত কাল মগ্ন থেকেছেন ইন্দ্রনাথ। ছেলেমেয়েরা যে ভাল রেজাল্ট করেছে, বড় মেয়ে এবং ছেলের বিয়ে সম্ভব হয়েছে, তা শুধু সুধাময়ীর জন্য। মৃদু, আপাতকোমল এই মানুষটির মধ্যে প্রবল এক ব্যক্তিত্ব রয়েছে। তিনি যা ভাবেন, শেষ পর্যন্ত করে ছাড়েন।
ইন্দ্রনাথ অস্বস্তি বোধ করছিলেন। বিব্রত মুখে বলেন, এবার দেখে নিও।
সুধাময়ী বলেন, দেখব। তোমাকে তিন মাস সময় দিলাম, তার মধ্যে মেয়ের বিয়ে না হলে আমি দাদাদের কাছে চলে যাব। এ বাড়ির সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক থাকবে না।
ভয়ে ভয়ে ইন্দ্রনাথ বলেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে, তিন মাসের ভেতরেই ছোট খুকির বিয়ে দেব।
খাওয়াদাওয়ার পর সুধাময়ী কিছুক্ষণের জন্য খাবার ঘরে থেকে গেলেন। পরদিন কী বাজার হবে, কোন কোন পদ রান্না হবে, সব বুঝিয়ে দেবেন দশরথকে।
ওদিকে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে উঠতে রণিতা জিজ্ঞেস করে, তুমি কি সত্যি সত্যি তিন মাসের মধ্যে আমার বিয়ে দেবে বাবা? তাকে ভীষণ চিন্তিত দেখাচ্ছিল।
ইন্দ্রনাথ বলেন, দিতে তো হবেই। তোমার মায়ের আদেশ। তাছাড়া আমাদের কাছে ছোট থাকলেও অন্যের চোখে আটাশ বছর বয়েসটা খুব কম না ছোট খুকি।
রণিতা বুঝতে পারে বাবা মজা করছেন না। ঢোক গিলে সে বলে, কিন্তু–
কী?
নয়নতারার ওপর ডকু-ফিচারটা করব বলে কথা দিয়েছি। এর ভেতর বিয়ে– বলতে বলতে চুপ করে যায় রণিতা।
ইন্দ্রনাথ বলেন, নিশ্চয়ই করবি ছবিটা। তবে বিয়েটাও করতে হবে।
ওরা দোতলায় উঠে এসেছিল।
রণিতা একটু চাপা গলায় ডাকে, বাবা–
তার কণ্ঠস্বরে এমন কিছু আছে যাতে কিছুটা অবাক হয়ে যান ইন্দ্রনাথ। বলেন, কী রে?
মুখ নামিয়ে রণিতা বলে, আমার বিয়ের জন্য তোমাকে কারো সঙ্গে কথা বলতে হবে না।
মানে?
একটু চুপ করে থাকে রণিতা। তারপর প্রায় ফিসফিস করে বলে, অমিতেশের সঙ্গে তোমার আলাপ করিয়ে দেব।
বুঝতে খানিকটা সময় লাগে ইন্দ্রনাথের। একসময় গলার স্বরটাকে উঁচুতে তুলে বলে ওঠেন, আই সি, আই সি। কী করে ছেলেটি?
জানালিস্ট।
আমাদের কাস্টের তো?
না। তুমি জাতপাত মানো?
নেভার। কিন্তু তোর মা মানেন, তাঁর অমতে কিছু করা প্রায় অসম্ভব।
রণিতা বলে, তুমি সোসাল জাস্টিসের কথা বল। মানুষে মানুষে ইকোয়ালিটির কথা বল, আর মায়ের নাম করে ইনজাস্টিসকে সাপোর্ট করতে চাইছ! তার গলায় ক্ষোভ ফুটে ওঠে।
মেয়ের কাঁধটা আলতো করে ছুঁয়ে ইন্দ্রনাথ একটু হাসেন, এত অস্থির হয়ো না। তোমার মাকে আঘাত দেওয়া তো কোনো কাজের কথা নয়। তিনি যাতে মনে কোনো দ্বিধা বা তিক্ততা না রেখে রাজি হন সেটা দেখতে হবে। তার জন্যে সময় দরকার। এবার ছেলেটি সম্পর্কে ডিটেলে বল।
বাবাকে যে ভুল বুঝেছিল, অকারণে তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল, সে জন্য মনে মনে লজ্জা পায় রণিতা। নিচু গলায় জানায় অমিতেশরা বাঙালি ক্রিশ্চান। তারা একভাই, এক বোন, বাবা নেই। সে বড়, ছোট বোন ইংরেজি নিয়ে যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে এম. এ করছে, খুব ভাল স্টুডেন্ট। মা একটা হায়ার সেকেন্ডারি মিশনারি স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপ্যাল। ডোভার লেনে ওদের নিজেদের বাড়ি।
ইন্দ্রনাথ বলেন, ঠিক আছে, জানা রইল। কিভাবে এগুবো, সেটা ভাবতে হবে। তোর মায়ের তো বটেই, আত্মীয়স্বজনদের সাপোর্টও পাওয়া দরকার।