খেতে খেতে রণিতা জিজ্ঞেস করে, তোমার না আজ সেন্ট্রাল ক্যালকাটা রোটারি ক্লাবে একটা সেমিনার ছিল?
ইন্দ্রনাথ বলেন, হ্যাঁ।
বিষয়টা যেন কী?
বাঃ, কালই তো তোকে বললাম। ভুলে গেছিস? সাবজেক্টটা হল নারী নির্যাতন।
ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। কেমন হল তোমাদের সেমিনার?
ইন্দ্রনাথ নিরুৎসুক সুরে বললেন, ভাল না। এসব যেন কিছু একটা করতে হয় তাই করা। অ্যাবসোলুটলি মেকানিক্যাল। নামকরা জানালিস্ট, অধ্যাপক, সোসাল ওয়াকার, পুলিশের বড় কর্তা, পলিটিক্যাল নেতারা এলেন। মেয়েদের ওপর যে ক্রাইম চলছে, সে সম্বন্ধে লম্বা লম্বা ভাষণ দিলেন কেউ কেউ, কেউ পেপার পড়লেন। এই নিয়ে প্রচুর আলোচনা হল। বাস এই পর্যন্ত।
রণিত বাবাকে লক্ষ করতে লাগল, কিছু বলল না।
ইন্দ্রনাথ থামেননি, বুঝলি ছোট খুকি, এভাবে এয়ার-কনডিশানড অডিটোরিয়ামে সেমিনার করে, দামি লাঞ্চ খেয়ে কাজের কাজ কিছু হবে না। উই শ্যাল হ্যাভ টুডু সামথিং পজিটিভ, ফিল্ডে নেমে যেতে হবে। যে মেয়েরা টরচারড হচ্ছে, তাদের পাশে দাঁড়িয়ে সব রকম সাহায্য দিতে হবে লিগ্যাল, মোরাল অ্যান্ড মনেটারি। কিভাবে এটা করা যায়, ভেবে দেখব। তারপর খুব তাড়াতাড়ি কাজে নামব। সে যাক, তোর তো আজ ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে যাবার কথা ছিল। গিয়েছিলি?
আস্তে মাথা নাড়ে রণিতা–গিয়েছিল।
দণ্ডকারণ্যের যে ট্রাইবটা নিয়ে কাজ করবি, তাদের সম্বন্ধে কিছু মেটিরিয়াল পাওয়া গেল?
প্রচুর। রণিতা বলে, কিন্তু বাবা, ওই ডকুমেন্টারিটা এখন আমি করছি না।
অবাক হয়ে ইন্দ্রনাথ বলেন, কেন রে?
ওটার আগে আমাকে অন্য একটা ডকু- ফিচার করে নিতে হবে।
বিষয়টা কী? নয়নতারার কথা বলে রণিতা।
ইন্দ্রনাথ সোজা হয়ে বসেন। বলেন, খুব ভাল সাবজেক্ট। এটা তোর মাথায় এল কী করে?
রজনীর সঙ্গে সন্ধেবেলায় ফোনে যে সব কথা হয়েছে মোটামুটি সব জানিয়ে রণিতা বলে, করতে পারলে দারুণ একটা ব্যাপার হয়, তাই না বাবা?
বেশ জোর দিয়ে ইন্দ্রনাথ বলেন, নিশ্চয়ই। কাজটা কিন্তু খুব ডিফিকাল্ট। ভদ্রমহিলার বহুদিন খোঁজ নেই। তাকে ছাড়া ছবিটা কিন্তু হতে পারে না।
আস্তে মাথা নাড়ে রণিতা।
ইন্দ্রনাথ বলেন, কিভাবে এগুবি, কিছু ভেবেছিস?
রণিতা জানায় এই সবে রজনীর কাছ থেকে দূরদর্শনের অফারটা পেয়েছে। এখনও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ভেবে উঠতে পারেনি। তবে প্রিন্ট মিডিয়ার সাহায্য নেবে, মণিময় চ্যাটার্জির সঙ্গে দেখা করবে, সেই সঙ্গে নয়নতারার সন্ধানও চালিয়ে যাবে। অমিতেশের নামটা অবশ্য করে না। আপাতত সেটা স্থগিত রইল, তবে মা যেভাবে তার বিয়ের ব্যাপারে অস্থির হয়ে উঠেছেন, ইন্দ্রনাথকে খুব তাড়াতাড়িই জানাতে হবে। রণিতার ধারণা, বাবা অমত করবেন না এবং সুধাময়ীকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে অমিতেশের ব্যাপারে রাজি করাতে পারবেন।
ইন্দ্রনাথ বলেন, হ্যাঁ, এটাই কারেক্ট ওয়ে। শুধু মণিময় চ্যাটার্জির সঙ্গে না, নয়নতারা যাঁদের সঙ্গে অভিনয় করেছেন সেই কো-অ্যাক্টররা, তাঁর ছবির প্রোডিউসার, ডিরেক্টর, আর্ট ডিরেক্টর, মেকআপম্যানদের অনেকেই বেঁচে আছেন। তাঁদের সঙ্গেও দেখা করতে হবে। ওঁরা অনেক মেটিরিয়াল দিতে পারবেন।
উৎসুক সুরে রণিতা বলে, তুমি ঠিক বলেছ বাবা। আর কী কী করা যায়, তুমি একটু চিন্তা কোরো।
অবশ্যই। বলতে বলতে হঠাৎ কী মনে পড়ে যাওয়ায় খুব উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠেন ইন্দ্রনাথ, জানিস তো, নয়নতারা স্টেজ অ্যাক্টিংয়ে নতুন স্টাইল নিয়ে এসেছিলেন।
শুনেছি। কিন্তু ওঁর নাটক দেখার সুযোগ পাইনি।
কী করে দেখবি! নয়নতারা যখন স্টেজ ছেড়েছেন তখন তোর বয়েস আর কত, খুব বেশি হলে বারো তেরো। ওই বয়েসে নাটক টাটক সম্পর্কে তোর ইন্টারেস্ট গ্রো করেনি।
রণিতা কিছু না বলে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে।
ইন্দ্রনাথ বলেন, যতটা মনে আছে, নয়নতারা সবসুন্ধু কুড়ি বাইশটা নাটকে অভিনয় করেছিলেন। আমার জানাশোনা এক ভদ্রলোক, নাম রমেন লাহা, এর মধ্যে চোদ্দ পনেরোটা প্রোডিউস করেছেন। উনি বেঁচে থাকলে নয়নতারা সম্পর্কে অনেক ইনফরমেশন পেয়ে যাবি।
রণিতা বলে, কাল রমেনবাবুর খোঁজ করবে?
ইন্দ্রনাথ বলেন, করব। মুনলাইট থিয়েটার হলটা ওঁদেরই। ওখানে ফোন করলে জানা যাবে।
ইন্দ্রনাথের কথা শেষ হতে না হতেই ডাইনিং রুমে বিস্ফোরণ ঘটে গেল। মাত্র পাঁচ ফুট দূরত্বে বসে নিঃশব্দে খেয়ে যাচ্ছিলেন সুধাময়ী। হঠাৎ তিনি চেঁচিয়ে ওঠেন, নাচাও নাচাও, যত পার মেয়েকে নাচিয়ে যাও।
খুব ধীর, নিমগ্ন গলায় কথা বলেন সুধাময়ী। কিন্তু এই মুহূর্তে তাঁর স্বর কয়েক পা উঁচুতে উঠেছে, উত্তেজনায় রন রন করছে। রাগে মুখ থমথমে।
সুধাময়ীর এমন চেহারা আগে আর দেখা যায়নি। রণিতারা হকচকিয়ে যায়।
ইন্দ্রনাথ ভয়ে ভয়ে বলেন, নাচাচ্ছি মানে?
স্বামীর কথা বুঝিবা সুধাময়ীর কানে যায় না। রুষ্ট মুখে বলতে থাকেন, কোথায় মেয়ের বিয়ে দেবে, সে আর দশজনের মতো ঘর-সংসার করবে, তা নয়। সিনেমা করার জন্যে সমানে উসকানি দিয়ে যাচ্ছে। এমন সৃষ্টিছাড়া বাপ আমি জীবনে দ্বিতীয়টি দেখিনি। একটু থেমে শুরু করেন, মেয়ে যখন পুনেতে যাবার জন্যে খেপে উঠল আমি বার বার বারণ করলাম কিন্তু কে কার কথা শোনে! লাফাতে লাফাতে গিয়ে তাকে ভর্তি করে এলে। এখন ক্যামেরা ঘাড়ে করে কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘর-সংসারে এ মেয়ের আর মন বসবে।