বাড়ির কুক দশরথ এই সময় এক কাপ কড়া ব্ল্যাক কফি আর কিছু চিজ বিস্কিট নিয়ে আসে। সে টের পেয়েছিল রণিতা ফিরে এসেছে।
দশরথের বয়স ষাটের কাছাকাছি কিন্তু এখনও পেটানো মজবুত চেহারা, প্রায় চল্লিশ বছর তার এ বাড়িতে কেটে গেল। রণিতাদের তিন ভাইবোনকে সে জন্মাতে দেখেছে। কখন কার কী দরকার সে জানে এবং নীরবে, অত্যন্ত মসৃণ নিয়মে সে সব জোগান দিয়ে যায়।
রণিতা উচ্ছ্বাসের গলায় বলে, দশরথদা, তুমি একজন দারুণ থট-রিডার। মনে মনে এখন এক কাপ কফি চাইছিলাম। বাঁচালে
দশরথ কথা খুব কম বলে। নিঃশব্দে হেসে একটা নিচু টিপয় টেবল খাটের কাছে টেনে এনে তার ওপর কফির কাপ টাপ রেখে চলে যায়।
আগস্ট মাস শেষ হয়ে এসেছে। বর্ষা এখনও পুরোপুরি বিদায় নেয়নি, আকাশে সেই বিকেল থেকে অল্প অল্প মেঘ জমতে শুরু করেছে। তবে সারাদিনে আজ একফোঁটা বৃষ্টি হয়নি। হয়তো বেশি রাতের দিকে হবে। মাঝে মাঝে পুব থেকে দক্ষিণে আড়াআড়ি বিদ্যুৎ চমকে যাচ্ছে।
কফিটা খেয়ে দেবব্রত বিশ্বাসের রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্যাসেট চালিয়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে খানিকক্ষণ শোনে রণিতা। তারপর একটা রঙিন বারমুডা প্যান্ট আর ঢোলা শার্ট হাতে ঝুলিয়ে অ্যাটাচড টয়লেটে ঢুকে যায়। শাওয়ার খুলে স্নান টান সেরে, পোশাক পালটে বেডরুমে এসে, চুলটুল আঁচড়ে ফের শুয়ে পড়ে।
ক্যাসেট এখনও বেজে যাচ্ছে। শুনতে শুনতে রণিতার দু চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসে।
.
০৩.
তিন ঘুমটা ভাঙে অনাথের ডাকাডাকিতে, ছোটদিদি, ওঠো ওঠো। খাবে না? বড়বাবু আর মা তোমার জন্যে বসে আছেন।
ধড়মড় করে উঠে পড়ে রণিতা, তারপর অনাথের সঙ্গে নিচে নামতে নামতে হলঘরের বড় ওয়াল ক্লকটায় দেখতে পায় এখন দশটা বেজে চল্লিশ।
এ বাড়ির রেওয়াজ হল রাতের খাওয়াটা সবাই একসঙ্গে বসে খায়। বিয়ের আগে রণিতার দিদি শমিতার প্রথমে কলেজ, পরে ইউনিভার্সিটিতে ছোটার ব্যাপার ছিল, রণিতারও তাই। দাদা পূর্ণেন্দুর ছিল অফিস, বাবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস। পূর্ণেন্দু ছাড়া অন্য কারো বেরুবার নির্দিষ্ট সময় ছিল না। কেননা রোজ একই সময়ে ওদের ক্লাস শুরু হত না। একেক জন একেক সময় খেয়ে বেরুত। রণিতার বাবা ইন্দ্রনাথ মনে করেন, দিনে অন্তত একবার বাড়ির সকলের একসঙ্গে বসা দরকার। এতে পারিবারিক সম্পর্কটা অনেক নিবিড় হয়। সেই জন্যই সবাই মিলে রাতে খাওয়ার ব্যবস্থা।
রণিতাদের খাওয়ার ঘরটা একতলায়। সেখানে আসতে দেখা যায়, ইন্দ্রনাথ আর সুধাময়ী ডাইনিং টেবলে বসে আছেন। এই ঘরটা আর কিচেনের মাঝখানে একটা দরজা, সেখানে দাঁড়িয়ে মুক্তা। দশরথই সবাইকে খেতে দেয়, মুক্তা এটা সেটা এগিয়ে দিয়ে তাকে সাহায্য করে।
ইন্দ্রনাথের বয়স সাতষট্টি। পাতলা মেদহীন চেহারা, লম্বাটে মুখে বুদ্ধির ধার। এই বয়সেও মেরুদণ্ড টান টান, চুলও খুব বেশি পাকেনি। চওড়া কপাল, ঈষৎ পুরু ঠোঁট, চোখের দৃষ্টি শান্ত কিন্তু দূরভেদী। গায়ের রং একসময় ছিল টকটকে, বয়স তার উজ্জ্বলতা অনেকটাই নষ্ট করে দিয়েছে। হালকা মলিন ছায়া পড়েছে ইন্দ্রনাথের ওপর।
হঠাৎ দেখলে তাঁকে খুব রাশভারী মনে হয়। কিন্তু একটু লক্ষ করলে টের পাওয়া যাবে গাভীর্যটা বাইরের খোলস মাত্র। তাঁর মধ্যে এমন একটি পরিহাসপ্রিয় মানুষ রয়েছে যে চারপাশের রুক্ষ কর্কশ আবহাওয়া থেকে আনন্দ আর মজাকে হেঁকে বার করে নিতে পারে।
ইন্দ্রনাথ ছিলেন ইউনিভার্সিটিতে সোসিওলজির দুর্ধর্ষ অধ্যাপক। শুধু সমাজতত্ত্ব নয়, ইতিহাস পুরাতত্ত্ব অর্থনীতি নৃতত্ত্ব ভারতীয় দর্শন, এমন কি সিনেমা নাটক ইত্যাদি নানা বিষয়ে তাঁর বিপুল আগ্রহ এবং অগাধ পড়াশোনা। এত পাণ্ডিত্য তাঁকে শুকিয়ে কাঠ করে দেয়নি। সব বয়সের মানুষের সঙ্গে তিনি অবাধে মিশতে পারেন, নিজের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বন্ধুর মতো।
ইন্দ্রনাথ মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, শুনলাম বাড়ি ফিরে তুই ঘুমিয়ে পড়েছিস। শরীর খারাপ নাকি?
রণিতা অল্প হেসে জড়ানো গলায় বলে, না বাবা, স্নানটান করে একটু শুয়েছিলাম। কখন ঘুম এসে গেছে, টের পাইনি।
এখনও ঘুম ভাবটা রয়েছে। যা, চোখে জল দিয়ে আয়।
ডাইনিং রুমের একধারে দুধসাদা বেসিন। পাশেই একটা র্যাকে ভোয়ালে, লিকুইড সোপ, ইত্যাদি।
ট্যাপ খুলে চোখে মুখে জলের ঝাঁপটা দিতেই আচ্ছন্নতা কেটে যায়। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে ইন্দ্রনাথের পাশে এসে বসে রণিতা। সঙ্গে সঙ্গে প্লেটে প্লেটে খাবার সাজিয়ে সবাইকে দিয়ে একটু দূরে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে দশরথ। রণিতাদের আরো কিছু দরকার হলে দেবে।
দিনের বেলা তাড়াহুড়ো করে খেয়ে সবাই বেরিয়ে যায়। কিন্তু ডিনারটা ওরা করে ধীরেসুস্থে, অনেকটা সময় নিয়ে। এই রাত্রিবেলায় তো আর ব্যস্ততা থাকে না, সকলেই তখন চাপমুক্ত, ঢিলেঢালা মেজাজে থাকে।
পূর্ণেন্দু, তার স্ত্রী বন্দনা আর শমিতারা যখন ছিল, আসর দারুণ জমে উঠত। সারাদিন কে কী করেছে, কার সঙ্গে দেখা হয়েছে, কোথায় গেছে, সবাই তা জানাতে। শুধু তাই না, দেশের রাজনৈতিক হালচাল, শেয়ার কেলেঙ্কারি, বেকারিত্ব, বম্বে ব্লাস্ট, অযযাধ্যা, ফুটবল, ক্রিকেট যাবতীয় বিষয় নিয়ে তারা বাড়ি সরগরম করে তুলত। পূর্ণেন্দুরা চলে যাবার পর আড্ডা আর তেমন হয় না। সুধাময়ী বরাবরই স্বল্পভাষী, বলার চেয়ে তিনি শোননন বেশি। আজকাল রণিতার বিয়ের ব্যাপারে তিনি এমনই ক্ষুব্ধ যে প্রায় সারাক্ষণই মুখ বুজে থাকেন। গল্প যা করার রণিতা আর ইন্দ্রনাথই করেন।