ডায়াল করে রণিতা দিনকাল-এর রিপোর্টিং সেকশানটা ধরে ফেলল কিন্তু অমিতেশকে পাওয়া গেল না।
ওধারে ফোনটা ধরেছিল অমিতেশের কলিগ এবং প্রিয় বন্ধু মৃণাল। রণিতাকে সে খুব ভালই চেনে। বলল, ফরাক্কায় আজ সকালে একটা মারাত্মক বাস অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। দশজন স্পট ডেড। কত জখম হয়েছে তার হিসেব পাওয়া যায়নি, ওদের ভেতর কয়েকজনের অবস্থা খুবইক্রিটিক্যাল। খবর আসার সঙ্গে সঙ্গে চিফ রিপোর্টার অমিতকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ওর ফিরতে অনেক রাত হবে।
অমিতেশের বন্ধু হিসেবে মৃণালের সঙ্গে রণিতার সম্পর্কটা বেশ মধুরই বলা যায়। মৃণাল দারুণ মজাদার মানুষ, রঙ্গপ্রিয়। খানিকটা ফাজিল ধরনের। তবে ওর মধ্যে বিন্দুমাত্র মালিন্য নেই। তাকে দেখলে, তার সঙ্গে কথা বললে মন ভাল হয়ে যায়। মৃণাল আর রণিতা পরস্পরকে নাম ধরে ডাকে।
রণিতা জিজ্ঞেস করে, অমিতের সঙ্গে আজ কি তোমার দেখা হতে পারে?
মৃণাল বলে, আমি এগারোটা পর্যন্ত অফিসে আছি। তার ভেতর এলে নিশ্চয়ই দেখা হবে। কী ব্যাপার? এনিথিং ভেরি আর্জেন্ট?
হ্যাঁ। ওকে বলল, কাল সকালে আমাকে যেন ফোন করে।
বলব।
যদি দেখা না হয় আমার নাম করে একটা মেসেজ রেখে দিও।
মৃণাল বলে, রাখব। তারপর ম্যাডাম—
রণিতা জিজ্ঞেস করে, কী?
আচমকা গলার স্বর পালটে ফিচেল স্বরে মৃণাল বলে, কেন অমিতকে এত ভোগাচ্ছ?
অবাক হয়ে রণিতা বলে, ভোগাচ্ছি। তার মানে?
সিম্পল। অমিত আর আমি একই ইয়ারে ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়েছি, একই দিনে দিনকাল-এ ঢুকেছি। দেখ এর ভেতর আমার বিয়ে হয়ে গেছে। নাউ আই অ্যাম আ প্রাউড ফাদার অফ থ্রি কিডস। তার মধ্যে দুটো আবার যমজ-টুইন। রেসে অমিত আমার থেকে কফার্লং পিছিয়ে পড়ল, একবার ভাবো। এ শুধু তোমার জন্যে–
আমার জন্যে!
নয় তো কী। তুমি করুণা করলে ওর নামটা ম্যারেডদের লিস্টে উঠে যেত। এতদিনে দু-চারটে ইন্ডিয়ান সিটিজেন কি আর ও পয়দা করতে পারত না?
রণিতা ধমকে ওঠে, একদম অসভ্যতা করবে না।
নিপাট ভালমানুষের গলায় মৃণাল বলে ওঠে, অসভ্যতা অবার কী! ইটস আ রিয়ালিটি অফ লাইফ। অমিত মা-বাবার একই ছেলে। ওর বিয়ে না হলে ওদের বংশের দফা রফা। শাস্ত্রে লেখা আছে বংশরক্ষা না করলে নরকে যেতে হয়। তুমি ওকে মহাপাপ থেকে বাঁচাও ম্যাডাম।
আবার ফাজলামো! এই আমি ফোন রাখছি। কিন্তু রাখতে গিয়েও হঠাৎ কিছু মনে পড়ে যাওয়ায় রণিতা বলে, আচ্ছা, তুমি একবার বলেছিলে না তোমার
কে একজন রিলেটিভ আছেন যিনি ফিল্মের সঙ্গে যুক্ত।
মৃণাল বলে, হ্যাঁ, আমার বড়মামা মণিময় চ্যাটার্জি। উনি মর্নিং স্টার কাগজের সিনেমা এডিটর ছিলেন।
ছিলেন মানে?
ওটা পাস্ট টেন্স, এখন আর নেই। বছর সাতেক হল রিটায়ার করেছেন।
উনি নিশ্চয়ই ফিল্ম ওয়ার্ল্ডের অনেক খবর রাখেন?
রাখেন কী বলছ! বড়মামা সিনেমার এনসাইক্লোপিডিয়া। হিরো-হিরোইন থেকে ডিরেক্টর, টেকনিশিয়ান, প্রোডিউসার, এমন কি ফালতু এক্সট্রাদের নামধাম ওঁর মুখস্থ। দিনের পর দিন পাবলিসিটি দিয়ে, ভাল ভাল লিখে কত অ্যাক্টর অ্যাকট্রেসকে ফেমাস করে দিয়েছেন তার হিসেব নেই।
উনি নিশ্চয়ই নয়নতারাকে চিনতেন?
নয়নতারা, মানে লিজেন্ডারি স্টেজ অ্যান্ড ফিল্ম অ্যাকট্রেসের কথা বলছ?
রাইট।
শুধু চেনেন! ওঁর কেরিয়ারের শুরুতে বড়মামা যেভাবে হেল্প করেছেন ভাবতে পারবে না। মণিময় চ্যাটার্জি সেই সময় ছিলেন নয়নতারার গডফাদার।
খুবই উৎসাহিত হয়ে ওঠে রণিতা। বলে, তোমার বড়মামার কাছে নয়নতারা সম্পর্কে তা হলে অনেক কিছু জানা যাবে।
আশ্চর্য।
কিসের আশ্চর্য?
মৃণাল জিজ্ঞেস করে, হঠাৎ নয়নতারাকে নিয়ে খেপে উঠলে কেন?
রণিতা বলে, দরকার আছে, পরে শুনো। তোমার বড়মামার কাছে আমাকে একবার নিয়ে যেতে পারবে?
তরল গলায় মৃণাল বলে, তোমার যখন হুকুম, পারতেই হবে। তবে—
কী?
বড়মামার শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। বয়স হয়েছে তো, তার ওপর তিন মাস আনে হার্টে একটা ম্যাসিভ অ্যাটাকও হয়ে গেছে। একটানা অনেকক্ষণ কথা বলা ডাক্তারের বারণ।
তুমি নিশ্চিন্ত থাকো, আমি ওঁকে বেশিক্ষণ বিরক্ত করব না।
আমি বড়মামাকে ফোন করে জেনে নেব কবে গেলে ওঁর অসুবিধা হবে না। টাইম আর ডেট ঠিক করে তোমাকে জানিয়ে দেব।
খুব আন্তরিক গলায় রণিতা বলে, মেনি, মেনি থ্যাংকস। এখন তা হলে ছাড়ি?
মৃণাল বলে, ওক্কে ম্যাডাম–
টেলিফোনটা নামিয়ে রেখে ঘুরে একবার হল-ঘরের দূর প্রান্তে তাকায় রণিতা। সেখানকার দৃশ্যাবলীর কোনোরকম পরিবর্তন হয়নি। সুধাময়ী তখনকার মতোই মহাভারতে নিমগ্ন হয়ে আছেন, আর মুক্তা ক্ষিপ্র হাতে পান সেজে যাচ্ছে।
এক পলক ওদের দেখে ব্যাগটা মেঝে থেকে তুলে নিয়ে, মুখ ফিরিয়ে হল ঘরটা কোনাকুনি পার হয়ে নিজের ঘরে চলে আসে বণিতা।
এ বাড়ির অন্য বেড-রুমগুলোর মতো এই ঘরটাও বিশাল, বিশ ফিট বাই পনেরো ফিট। খাট, আলমারি, বইয়ের র্যাক, ওয়ার্ডরোব, ড্রেসিং টেবল, সোফা, পড়ার টেবল, ইত্যাদি দিয়ে চমৎকার সাজানো। শুধু বাইরের হল-ঘরই না, এ ঘরেও ক্যাবিনেট বোঝাই নানা ফিল্ম আর গানের ক্যাসেট। একটা পোর্টেবল ফরেন টিভি আর টু-ইন-ওয়ানও রয়েছে।
ব্যাগটা একটা সোফায় রেখে, আলো জ্বেলে ফ্যান চালিয়ে দেয় রণিতা। তারপর জুতো খুলে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে।