অমিতেশ আর রণিতা একসঙ্গে বলে ওঠে, দেখবে না মানে। সারা শহর। আপনার নাটকের জন্য উন্মাদ হয়ে যাবে।
কলাকুঞ্জ কলকাতার সবচেয়ে অভিজাত হল। ওখানে অনুষ্ঠান করার জন্য মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানির অফিসার্স ক্লাব থেকে শুরু করে বড় বড় গ্রুপ থিয়েটারগুলো সারা বছর লাইন দিয়ে থাকে।
মাস দুই ঘোরাঘুরির পর দ্রৌপদী নাটকের জন্য একটা ডেট পাওয়া গেল। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ঠিক হয়েছে আপাতত দশটা শো করা হবে। তাতেও যদি সব টাকা না ওঠে, আরো শো করতে হবে।
নাটক মঞ্চস্থ হবার কুড়ি দিন আগে পাবলিসিটি শুরু হল। নয়নতারার চার ফুট ছবিওলা পোস্টারে পোস্টারে গোটা শহর ছয়লাপ। তা ছাড়া কাগজে কাগজে বিরাট বিরাট বিজ্ঞাপন বেরুতে লাগল। টিভিতেও দিনে দু বার করে প্রচার চলল। বড় বড় মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানিগুলো নাটকটা স্পনসর করার জন্য রণিতাদের অতিষ্ঠ করে তুলেছে। প্রথম শো-এর জন্য নয়নতারা স্পনসর নিতে একেবারেই রাজি নন। যা করার রণিতাদের সাহায্য নিয়ে নিজের উদ্যোগেই আপাতত করতে চান।
রণিতারা যা ভেবেছিল, দেখা গেল নয়নতারার নাটক নিয়ে উদ্দীপনা তার হাজার গুণ বেশি। অ্যাডভান্স বুকিংয়ের কাউন্টার খোলা হয়েছিল পাঁচ দিন আগে। টিকেটের জন্য এক কিলোমিটার লম্বা লাইন পড়ে গিয়েছিল। কাউন্টার খোলার দু ঘন্টার ভেতর সব টিকেট শেষ। যারা টিকেট পায় নি, খেপে গিয়ে কাউন্টার ভাঙচুর করেছে। অগত্যা কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে জানানো হয়েছে, খুব শিগগিরই আবার দ্রৌপদীর শো করা হবে। কলাকুঞ্জ-এ বুকিং না পাওয়া গেলে অন্য হল এ নাটকটি মঞ্চস্থ করবেন নয়নতারা।
আসলে গত আট বছরে এত বড় ঘটনা সাংস্কৃতিক জগতে আর ঘটে নি। নয়নতারা আবার অভিনয় করবেন, এটা জানা মাত্র সারা শহর তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে।
নাটকের জন্য নির্দিষ্ট দিনটি এসে গেল। যারা টিকেট পেয়েছে তারা অনেক আগেই হল-এ ঢুকে পড়েছে। যারা পায় নি, এমন কয়েক হাজার মানুষ নয়নতারাকে দেখার জন্য কলাকুঞ্জ-এর সামনে দু ঘন্টা আগে থেকে জমা হয়েছে। ভিড়ের ভেতর দিয়ে হল-এ যেতে বেশ কষ্টই হল নয়নতারার।
ভেতরে শখানেক ফটোগ্রাফার আর টিভির ক্যামেরাম্যান গিস গিস করছিল।
কিছুক্ষণ পর পর্দা ওঠার সঙ্গে সঙ্গে যেই দ্রৌপদীর মেক-আপ নিয়ে নয়নতারা মঞ্চে প্রবেশ করলেন, চারদিক থেকে ক্যামেরার ফ্ল্যাশগুলো অনবরত জুলতে লাগল। গোটা হল-এর দেড় হাজার দর্শক উঠে দাঁড়িয়ে যেন হিস্টিরিয়ার ঘোরে চেঁচাতে চেঁচাতে হাততালি দিতে থাকে। আট বছর বাদে তাকে দেখে সবাই যেন উন্মাদ হয়ে গেছে।
কী আশ্চর্য ব্যক্তিত্ব নয়নতারার! হাত তুলে সবাইকে পলকে থামিয়ে দেন। তারপর শুরু হয় অভিনয়।
এক পাশে মঞ্চের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল রণিতা। কয়েক মিনিটের ভেতর সে টের পায় সমস্ত হলটা একেবারে নিঝুম হয়ে গেছে। মঞ্চে এখন যেন এক অপার্থিব ম্যাজিক তৈরি হচ্ছে।
যে নয়নতারাকে চার মাস ধরে দেখে আসছে রণিতা, তাকে এখন আর চেনা যায় না। তার কণ্ঠস্বর, বাচনভঙ্গি, চলাফেরা, তাকানো, সব আগাগোড়া বদলে গেছে। মহাভারতের দ্রৌপদীকে তিনি যেন ধীরে ধীরে নির্মাণ করছেন। পলকহীন, আচ্ছন্নের মত তাকিয়ে ছিল রণিতা। এতকাল বাদে যে উদ্দেশ্যে নয়নতারা মঞ্চে উঠেছেন সেটা যেন তাকে ক্রমশ মহিমান্বিত করে তুলছিল।
জীবনে পূর্ণতা কাকে বলে, নয়নতারাকে দেখতে দেখতে বার বার তা উপলব্ধি হচ্ছিল রণিতার।