নিয়মিত যাতায়াতের ফলে রণিতাদের জানা হয়ে গেছে, গোপনে প্রচুর দান করে থাকেন নয়নতারা। সারা জীবনে অজস্র টাকা রোজগার করেছেন তিনি। তার একটা বড় অংশ ফিক্সড ডিপোজিট করে রেখেছেন। এতে মোটা সুদ পাওয়া যায়। সেই টাকাটা বহুজনের হিতে অকাতরে খরচ করে থাকেন। কোন মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না, কোন দাঁতব্য প্রতিষ্ঠান পয়সার অভাবে বস্তিতে ওষুধপত্র দিতে পারছে না, কোথায় কোন গ্রাম বন্যায় ভেসে গেছে। জানা মাত্র টাকা পাঠিয়ে দেন।
নয়নতারার পক্ষে তো বাড়ি থেকে বেরুনো সম্ভব না। বেরুলে মিডিয়ার লোকেরা একেবারে হুলস্থুল বাধিয়ে ছাড়বে। তার অজ্ঞাতবাসের শান্তি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাবে। সেটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। তার হয়ে এ সব করে থাকেন সমরেশ।
আসলে মানুষের জন্য কিছু করতে চান নয়নতারা। এখনও গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ড তার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। কী পাননি তিনি? অর্থ, খ্যাতি, সম্মান, যশ, সেই সঙ্গে বিপুল পরিমাণে দুর্নাম। সব সময় তিনি প্রচারের কেন্দ্রবিন্দুতে। তাকে ঘিরে সারা দেশ জুড়ে আজও প্রবল উন্মাদনা। কিন্তু এ সব নয়নতারাকে ক্লান্ত করে তুলেছিল। জীবনের অন্য একটি অর্থও যে আছে, একদিন তারই খোঁজে তিনি সব কিছু ছেড়ে গ্ল্যামারের জগৎ থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু খুব বেশি কিছু করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে নি। মিডিয়া তার এমন একটা ইমেজ তৈরি করে দিয়েছে যে সেটা ভেঙে একজন সাধারণ নাগরিকের মতো রাস্তায় বেরিয়ে কিছু যে করবেন তার উপায় নেই। সেই জন্যই সমরেশকে তার প্রয়োজন। সমরেশকে দিয়েই বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে তিনি যোগাযোগ রেখে চলেছেন।
একদিন খুব সকালে আলিপুরে এসে বেশ অবাকই হল রণিতা আর অমিতেশ। দোতলার হল-ঘরে তাদের জন্য অপেক্ষা করছেন সমরেশ এবং নয়নতারা। সমরেশ কখনও এত সকালের দিকে এ বাড়িতে আসেন না। অসময়ে তার আসাটাই রণিতাদের বিস্ময়ের কারণ।
হল-এ বসে ব্রেকফাস্ট করতে করতে নয়নতারা বললেন, তোমাদের অনেক বার বলেছি, একটা জরুরি কাজে তোমাদের সাহায্য চাই। মনে আছে?
রণিতা বলে, নিশ্চয়ই। কী কাজ বলুন না
নন-ক্রিমিনাল লুনাটিক কাদের বলে জানো?
জানি। যারা অপরাধী নয়, তবে নানা কারণে যাদের মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে–
ঠিক। এরকম বত্রিশটি নানা বয়সের মেয়েকে জেলে আটকে রাখা হয়েছিল। কাল তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে।
রণিতা শিরদাঁড়া টান টান করে বলে, এদের রিলিজের কথাই কি সেদিন মিস্টার ভোমিককে বলেছিলেন?
হ্যাঁ।
আস্তে আস্তে মাথা নাড়েন নয়নতারা। বলেন, এই মেয়েদের আত্মীয়স্বজনরা ওদের বাড়ি ফিরিয়ে নিতে চায় না।
রণিতা চমকে ওঠে, তা হলে ওরা কোথায় যাবে? কে দেখবে ওদের?
নয়নতারা জানান, এই নিরাশ্রয় মেয়েদের জন্য টালিগঞ্জে আপাতত কয়েক বছরের জন্য একটা বাড়ি লিজ নেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কসবায় যে জমিটা তিনি কিনেছেন সেখানে একটা চারতলা বাড়ি করা হবে। সেটা হয়ে গেলে, মেয়েরা ওখানে গিয়ে স্থায়ীভাবে থাকবে। তাদের সব দায়িত্ব নয়নতারার। এই কাজটা যদি শেষ পর্যন্ত সুষ্ঠুভাবে করতে পারেন, নিজের বেঁচে থাকার একটা অর্থ হয়।
অনেক আগে থেকেই এই পরমাশ্চর্য মহিলাটিকে শ্রদ্ধা করতে শুরু করেছিল রণিতা। শ্রদ্ধাটা এখন শতগুণ বেড়ে যায়। অভিভূতের মতো সে নয়নতারার দিকে তাকিয়ে থাকে।
নয়নতারা বলেন, এবার শোন তোমাদের কাছে কী সাহায্য চাই।
উৎসুক সুরে রণিতা বলে, বলুন।
যে মেয়েদের কাল জেল থেকে ছেড়ে দিচ্ছে তাদের চিকিৎসা আর খাওয়া পরার জন্যে প্রচুর টাকা দরকার। তাছাড়া ওদের জন্যে কসবায় বাড়িটাও করতে হবে। আমার কাছে অত টাকা নেই যাতে এতবড় দায়িত্ব পালন করা যায়। তাই কিছুদিন ধরেই ভাবছি– কথা শেষ না করে তিনি থেমে যান।
রণিতা কিছু বলে না, উদগ্রীব হয়ে থাকে।
নয়নতারা বলেন, ভাবছি, আমি আবার অভিনয়ের মধ্যে ফিরে যাব। এ ছাড়া কোথায় টাকা পাব? বলে একটু হাসেন।
রণিতার স্নায়ুমণ্ডলীর মধ্যে বিদ্যুৎপ্রবাহ খেলে যায় যেন। সে প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে, এ তো দারুণ খবর। কোন ডিরেক্টরের ছবিতে নামবেন, কিছু ঠিক হয়েছে?
ফিল্মে নামছি না।
তবে?
স্টেজে নামব।
কী নাটক?
দ্রৌপদী। ওটা আমারই লেখা। তোমরা জানতে চেয়েছিলে না, আমি কী লিখি? সেদিন জানাই নি, আজ বলি তিন বছর ধরে একটু একটু করে ওই নাটকটা লিখেছি। মহাভারতের এই চরিত্রটা আমার কাছে দারুণ সিগনিফিকাষ্ট মনে হয়েছে। লিখে খুব আনন্দ পেয়েছি। নয়নতারা বলতে থাকেন, আর একটা কথা, এই নাটকে আমি একটা এক্সপেরিমেন্ট করতে চাই।
রণিতা জিজ্ঞেস করে, কিরকম?
দ্রৌপদী তো বটেই, তাকে ঘিরে যত চরিত্র এসেছে সবগুলোতেই আমি অভিনয় করব।
একটু চুপ।
তারপরনয়নতারা আবার বলেন, আপাতত এইঅভিনয়ের ব্যাপারে কোনো প্রচার আমি চাই না। মিউজিক ডিরেক্টর বসন্ত মুখার্জি আর লাইটের সুনীল সেনকে দু-একদিনের ভেতর ফোন করব। তোমরা ওঁদের এখানে নিয়ে আসবে।
ওঁরা যদি কাউকে জানিয়ে দেন?
আমি অনুরোধ করলে আগে থেকে কাউকে জানাবেন না। ওঁদের ওপর আমার বিশ্বাস আছে। ফাইনাল রিহার্সাল হবার পর তোমরা কলাকুঞ্জ হলটা ভাড়া করবে, দর্শকদের জন্যে টিকেট ছাপাবে, পুলিশ আর কর্পোরেশনের পারমিসান নেবে। তারপর টিভি আর কাগজে কাগজে আমার ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন দেবে। অনেক দিন পর স্টেজে নামতে যাচ্ছি, একটু নার্ভাস লাগছে। তোমাদের কি ধারণা, লোকে আমার নাটকটা দেখবে না?