রণিতা এই সময় আচমকা বলে ওঠে, একটা কথা জিজ্ঞেস করব, কিছু মনে করবেন না?
নয়নতারা বলেন, না, করব না।
সমরেশবাবুর সঙ্গে আপনার যা সম্পর্ক, সে ব্যাপারে বিবেকের দিক থেকে আপনি কি পরিষ্কার?
চোখের দৃষ্টি স্থির হয়ে যায় নয়নতারার। ধীরে ধীরে অনুচ্চ কিন্তু তীব্র স্বরে জিজ্ঞেস করেন, কী বলতে চাইছ?
কিছুক্ষণ আগে বলেছিলেন, একজন হিরোর সঙ্গে আপনার হৃদয়ঘটিত রিলেশান গড়ে উঠেছিল। কিন্তু তিনি বিবাহিত জানার পর তার সঙ্গে আর কোন সম্পর্ক রাখেন নি। সেদিক থেকে সমরেশবাবুর সঙ্গেও তো আপনার যোগাযোগ থাকার কথা নয়।
শিরদাঁড়া টান টান হয়ে যায় নয়নতারার। তীক্ষ্ণ চোখে রণিতাকে লক্ষ করতে করতে বলেন, তার মানে?
মানে সমরেশবাবুও বিবাহিত। এথিকসের এই পর্যন্ত বলে থেমে যায় রণিতা।
নয়নতারা হকচকিয়ে যান। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকেন তিনি, তারপর বলেন, সমরেশ বিবাহিত, তুমি জানলে কী করে? হঠাৎ কী মনে পড়ে যাওয়ায় পরক্ষণে দ্রুত বলে ওঠেন, ও, বুঝেছি। বেনামা যে চিঠিটা পেয়েছ তাতেই এই খবরটা রয়েছে, কী বল?
হ্যাঁ।
নিঃশব্দে বসে বসে ওদের কথাবার্তা শুনছিলেন সমরেশ। বলেন, নিশ্চয়ই শীলা এ সব জানিয়েছে।
রণিতা সমরেশের দিকে ঘুরে বসে, নয়নতারা দেবী সম্পর্কে যেমন, তেমনি আপনার সম্বন্ধেও ওই চিঠিতে প্রচুর অভিযোগ। আপনার ছেলেমেয়ে স্ত্রী, সবাইকে নাকি ভাসিয়ে দিয়ে চলে এসেছেন।
আস্তে আস্তে মাথা নাড়েন সমরেশ। অনেকক্ষণ নিঝুম হয়ে বসে থাকার পর বলেন, অভিযোগটা ঠিক। সংসারের প্রতি বিশেষ কোনো কর্তব্য আমি পালন করতে পারিনি। কিন্তু মানুষ তো দেবতা নয়। নয়নের মধ্যে এমন কিছু আছে যা আমাকে ঘর থেকে বার করে এনেছিল।
এর জন্যে আপনি কি অনুতপ্ত?
সন্তান এবং স্ত্রীর জন্য দুঃখ হয়, মনও খারাপ লাগে, কিন্তু অনুতাপ নেই।
কিন্তু–
হাত তুলে রণিতাকে থামিয়ে দিয়ে সমরেশ বলেন, তুমি হয়তো বলতে চাইছ স্ত্রী-ছেলেমেয়েদের ফেলেও এলাম, বাইরে এসেও কিছুই পেলাম না।
রণিতা বলে, হ্যাঁ, মানে–
সমরেশ বলেন, বিশ্বাস কর, নয়নের কাছে আমি এমন কিছু পেয়েছি যা এই পৃথিবীতে আর কেউ আমাকে দিতে পারত না।
কী সেটা?
তোমাদের এই বয়সে তা বুঝবে না।
কিছুক্ষণ নীরবতা।
তারপর সমরেশ অনেকটা স্বগতোক্তির মতো বলে ওঠেন, পাপপুণ্য নিয়ে আমি চিন্তা করি না। মৃত্যুর পর মানুষের কী পরিণতি, আমার জানা নেই। হয়তো অনন্ত নরকে আমার স্থান হবে। তবে একটা কথা স্পষ্ট করে বলি, এ জীবনে অনেক কিছু হারিয়েছি, কিন্তু পেয়েছি তার বহুগুণ। তাতেই আমার তৃপ্তি। এর জন্যে আমাকে বহু মূল্য দিতে হয়েছে। পরলোক বলে যদি কিছু থাকে সেখানেও অপেক্ষা করছে চরম কোনো শাস্তি। তার জন্যে আমি প্রস্তুত। এটাই আমার নিয়তি।
সমরেশ যেন কাছে বসে নেই, অনেক দূর থেকে তাঁর কণ্ঠস্বর বুঝিবা অদৃশ্য বায়ুস্তর ভেদ করে ভেসে আসতে থাকে।
রণিতা বা অমিতেশ কেউ আর কোন প্রশ্ন করে না। হল-ঘরের আবহাওয়া কেমন যেন ভারি হয়ে উঠতে থাকে।
অনেকক্ষণ পর নয়নতারা বলেন, লাভ, সেক্স, স্ক্যান্ডাল, পাপপুণ্য– এ সব তো অনেক হল। কিন্তু এর বাইরেও জীবনে আরো অনেক কিছু আছে। এবার বরং সে বিষয়ে একটু মন দেওয়া যাক।
রণিতা আর অমিতেশ চকিত হয়ে ওঠে, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। নয়নতারা সমরেশের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করেন, কসবার ওই জায়গাটাকে ঘিরে কম্পাউন্ড ওয়াল তোলার ব্যবস্থা করেছ তো?
সমরেশ বলেন, কাল মিস্তিরিদের সঙ্গে কথা হয়েছে। কী খরচ পড়বে ওদের জানাতে বলেছি। চিন্তা করো না, দিন পনের কুড়ির ভেতর ওয়াল উঠে যাবে।
কসবার কোন জায়গাটা নিয়ে নয়নতারারা কথা বলছেন, রণিতার বুঝতে অসুবিধে হয় নি। সে জিজ্ঞেস করে, জমিটা কেনা হয়ে গেছে?
ওই জমিটার ব্যাপারে খোঁজখবর করতে রণিতারা যে কসবায় ছুটেছিল তা নিয়ে নয়নতারার সঙ্গে আগেই একদিন ওদের আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, হ্যাঁ, লাস্ট উইকে রেজিস্ট্রি হয়েছে।
রণিতা মনে মনে ভেবে দেখল, সেই সময়টা সে জ্বরে বিছানায় পড়ে ছিল। নইলে এই কেনার খবরটা আগেই জেনে যেত। বলল, ওখানে মেয়েদের একটা হোম করার কথা ভেবেছিলেন না?
নয়নতারা বলেন, হোমই তো করব।
কোন মেয়েদের জন্যে?
আর কয়েক দিন অপেক্ষা কর, সব জানতে পারবে। বলে সমরেশকে জিজ্ঞেস করেন, ওদের কবে রিলিজ করা হচ্ছে?
সমরেশ বলেন, নেক্সট মানথে।
ওদের থাকার কোনো অ্যারেঞ্জমেন্ট করেছ?
না। এখনও করে উঠতে পারি নি। তিনজন দালালের সঙ্গে কথাবার্তা চলছে। টালিগঞ্জে একটা বাড়ি কয়েক বছরের জন্যে লিজে পাওয়া যাবে, মনে হচ্ছে।
ওরা রিলিজ পাওয়ার আগে যেভাবেই হোক বাড়িটার ডিল কমপ্লিট করে ফেলবে। নইলে খুব মুশকিলে পড়ে যাব।
ডিল হয়ে যাবে।
কারা কোত্থেকে রিলিজ পাবে, কাদের থাকার জন্য বাড়ি লিজ নেওয়া হবে, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। এ সব সম্পর্কে রণিতা জানতে চায়।
নয়নতারা এবারও তাকে ধৈর্য ধরতে বলেন।
রণিতা আর কিছু জিজ্ঞেস করে না।
.
২১.
আরো কয়েক দিন কেটে যায়।
এর ভেতর নয়নতারার দৈনন্দিন রুটিনটা মুখস্থ হয়ে গেছে রণিতাদের। ভোরবেলায় উঠে প্রথম আসন, তারপর স্নান, শ্লোকপাঠ, নিজের স্টাডিতে বসে নিবিষ্ট হয়ে লেখাপড়া– এইসব কর্মসূচিতে কোনরকম হেরফের নেই। এরই ফাঁকে ফাঁকে বাইরের লোকজনের সঙ্গে ফোনে কথাবার্তা তো আছেই।