অবাক হয়ে নয়নতারা জিজ্ঞেস করেন, কার কথা বলছ? তার প্রশ্নটি শেষ হতে না হতেই সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ শোনা যায়। পরক্ষণে দোতলার হল-ঘরে যিনি উঠে আসেন তাকে আগে না দেখলেও কিছুকাল আগে নর্থ বেঙ্গল থেকে এক মহিলার বেনামি চিঠিতে তাঁর চেহারার বর্ণনা পাওয়া গিয়েছিল। বর্ণনাটি এতই নিখুঁত যে অমিতেশ আর রণিতার স্পষ্ট মনে আছে। অতএব ভদ্রলোককে চিনতে তাদের বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না।
নয়নতারা বলেন, তোমার না সকালে আসার কথা ছিল? এত দেরি করলে?
ভদ্রলোক বলেন, একটা ঝামেলায় আটকে গেলাম। তাই—
নয়নতারা বলেন, ও। এস তোমাদের আলাপ করিয়ে দিই। এ হল–
আলাপ না করিয়ে দিলেও চলবে। তোমার মুখে ওদের কথা এত শুনেছি যে ইনট্রোডিউস না করে দিলেও চিনতে অসুবিধা হচ্ছে না। ওরা হল রণিতা আর অমিতেশ।
অমিতেশ বলে, আমরাও আপনাকে চিনি। পরিচয় করানোর দরকার নেই।
দুচোখে বিস্ময় নিয়ে নয়নতারা জিজ্ঞেস করেন, চেনো? এ কে বল তো?
সমরেশ ভৌমিক।
তোমরা জানলে কী করে? আগে কি কখনও ওকে দেখেছ?
না।
তা হলে?
অমিতেশ চকিতে একবার রণিতার দিকে তাকায়। সে যা বলতে চায় সেটা বলা ঠিক হবে কিনা বুঝে নিতে চায়। রণিতা মাথা নাড়ে, অর্থাৎ বলা যেতে পারে।
অমিতেশ বলে, নর্থ বেঙ্গল থেকে মাসখানেক আগে আমরা একটা চিঠি পেয়েছিলাম, তাতে ওঁর চেহারার ডেসক্রিপশান আছে। তার থেকেই চিনে ফেললাম।
শুধু ডেসক্রিপশান থেকে চেনা যায়?
তা হয়তো যায় না। তবে চিঠিটায় এমন কিছু আছে যার সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে উনি সমরেশ ভৌমিক ছাড়া অন্য কেউ হতে পারেন না। তা ছাড়া মাঝে মাঝে আপনি ফোনে কোনো এক সমরেশ-এর সঙ্গে কথা বলেন। তার থেকেও কু পেয়ে গেলাম।
নয়নতারা গালে তর্জনী ঠেকিয়ে বলেন, কী সাঙ্ঘাতিক ছেলেমেয়ে রে বাবা!
সমরেশ শ্বাসরুদ্ধের মতো বসে ছিলেন। বলেন, চিঠিটা কে লিখেছে?
রণিতা বলে, নিচে নাম নেই। অ্যানোনিমাস লেটার।
আমার সম্বন্ধে কী লেখা আছে তাতে?
সত্যিই শুনতে চান?
সমরেশ রীতিমত থতিয়ে যান। গলার স্বর নামিয়ে বলেন, আপত্তির কিছু। নেই।
রণিতা বলে, সেটা কিন্তু আপনার পক্ষে খুব প্রীতিকর হবে না।
নয়নতারা ওদের লক্ষ করছিলেন। বলেন, বুঝেছি, ওই চিঠি তোমার স্ত্রী শীলা দিয়েছে।
সমরেশ চুপ কবে থাকেন।
অমিতেশ এই সময় বলে, কিছুক্ষণ আগে বলেছিলাম, ইমোশানাল রিলেশনশিপ গড়ে উঠেছিল, এমন সবার কথা জানালেও, একজনের কথা আপনি গোপন করে রেখেছেন। সমরেশবাবু সম্পর্কেই বলেছি। ওঁর সঙ্গে আপনি যে এখনও গভীরভাবে জড়িয়ে আছেন সেটা না বলে দিলেও চলে।
নয়নতারা স্তম্ভিত। সমরেশের সামনে এমন উঁছাছোলা ভাষায় কেউ যে বলতে পারে, ভাবা যায় না।
তার মুখের দিকে তাকিয়ে অমিতেশের মনে হয়, এভাবে বলাটা বোধ হয় ঠিক হয়নি। সে বলে, আসলে কী জানেন, আপনাদের আঘাত দেবার বা বিব্রত করার জন্যে আমি কথাটা বলিনি। শুধু জানতে চেয়েছি টুথ, টুথ ওনলি, যেটুকু পেলে আমাদের সময়ের শ্রেষ্ঠ স্ক্রিন আর স্টেজ পার্সোনালিটিকে বুঝতে কিছুটা সুবিধা হবে।
অনেকক্ষণ স্থির চোখে অমিতেশের দিকে তাকিয়ে থাকেন নয়নতারা। তারপর বলেন, কোন টুথ তুমি জানতে চাও?
অমিতেশ বলে, আপনি তো অকপটে নিজের জীবনের এমন সব কথা বলেছেন যা ভারতবর্ষের অন্য কোনো মহিলা বলত কিনা সন্দেহ। আমি জানতে চাইছি সমরেশবাবুর সঙ্গে আপনার সম্পর্কটা ঠিক কী ধরনের?
এক মুহূর্তও না ভেবে নয়নতারা বলেন, গভীর বন্ধুত্বের। এবং তোমরা যা ইঙ্গিত করছ সেটা একেবারেই ঠিক নয়।
ইঙ্গিত? কিসের?
তোমরা নিশ্চয়ই জানতে চাইছ, সমরেশের সঙ্গে কোনোরকম ফিজিক্যাল রিলেশন আছে কিনা– এই তো?
যে অমিতেশ অত্যন্ত স্পষ্টভাষী, ঘুরিয়ে কথা বলা যার একেবারেই অপছন্দ সে পর্যন্ত বিব্রত বোধ করে। সমরেশের সামনে এভাবে নয়নতারা বলবেন, ভাবা যায়নি, যদিও ঠিক এটাই জানতে চেয়েছে অমিতেশ। তার মুখ লাল হয়ে ওঠে। কী উত্তর দেবে ভেবে পায় না।
অমিতেশকে লক্ষ করতে করতে হয়তো একটু করুণাই হয় নয়নতারার। চোখ টিপে মজার গলায় বলেন, ও আমার শুধু বন্ধু– প্রাণের সখা। ওই যে দারুণ একটা পদ আছে, নিকষিত হেম কামগন্ধ নাহি তায়– ওর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা হুবহু তাই। জানো, যে আটটা বছর আমি অজ্ঞাতবাসে আছি, ও আমাকে আগলে আগলে রেখেছে। সমরেশ পাশে না থাকলে আমার কী অসুবিধা যে হতো বলে বোঝাতে পারব না।
অমিতেশ জিজ্ঞেস করে, উনি থাকেন কোথায়?
সকৌতুকে নয়নতারা বলেন, তুমি যে একেবারে ক্রিমিনাল লইয়ারের মতো জেরা শুরু করলো একটু থেমে বলেন, কী জানতে চাইছ তা অবশ্য বুঝতে পারছি। আমি আর সমরেশ একই বাড়িতে থাকি কিনা– কেমন?
অমিতেশ চুপ।
নয়নতারা বলেন, এক বাড়িতে থাকলে আমাদের সম্বন্ধে একটা খুব সহজ কনকনে যে কেউ আসতে পারে। যদিও একটু আগে জানিয়েছি আমাদের সম্পর্কের ভেতর সেক্সের আঁশটে গন্ধ নেই, তবু হয়তো তোমার বিশ্বাস হয়নি। কিন্তু যত বার যেভাবেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জানতে চাও, আমার উত্তর একটাই– সমরেশ আমার বন্ধু এবং প্রেমিকও। তবে প্রেম তত বহুৎ কিসিমকা। সব সময় একটি পুরুষ আর একটি রমণীর বিছানায় ওঠাটাই তার আলটিমেট গোল নয় অমিতেশ। সে যাক, তোমার অবগতির জন্যে জানাই,যাদবপুরে সমরেশের একটা ফ্ল্যাট আছে।ও সেখানেই থাকে এবং রোজ একবার এখানে এসে আমার দেখাশোনা করে যায়।