নয়নতারা আরো যা বলেন তা এইরকম। কয়েক বছরের ভেতর লোকটা পুরনো বদনাম প্রায় সবটাই কাটিয়ে রীতিমত একজন নেতা হয়ে উঠল। খুবই প্রতিভাশালী সে। একদিন তার নজর এসে পড়ল নয়নতারার ওপর। গোড়ায় এক মাস কি দুমাস পর একবার ফোন করত, গদগদ হয়ে বলত, সে নয়নতারার একনিষ্ঠ ভক্ত, তার প্রতিটি ছবি আর নাটক ওর দেখা। একজন ব্যস্ত জননেতা বিপুল কাজের ফাঁকে ফাঁকে তাঁর ফ্লিম-টিল্ম দেখে ফোন করছে, এ তো শুধু খুশি নয়, রোমাঞ্চিত হবার মতো ঘটনা।
ক্রমশ ফোনের উৎপাতটা বাড়তে লাগল। এক-দুমাসের বদলে কবে বোজ রাতে সে রিং করা শুরু করল, এখন আর মনে পড়ে না। কিন্তু পরম ভক্তটির ভেতর থেকে দ্রুত অন্য একটা চেহারা বেরিয়ে আসতে লাগল। নয়নতারাকে রোজ একবার না দেখতে পেলে জীবন নাকি ব্যর্থ হয়ে যাবে। তার আবদার, প্রতিদিন রাতে সে একবার নয়নতারার বাড়ি আসবে। কোনো ভয় নেই, কেউ যাতে টের না পায়, সেইভাবেই যাবে সে। পরিষ্কার বোঝা গেল, লুকিয়ে চুরিয়ে সে অভিসারে আসতে চায়। নয়নতারা বুঝিয়ে দিলেন, অমন একটা বেয়াড়া সময়ে তাকে কোনোভাবেই তার বাড়িতে অভ্যর্থনা জানানো সম্ভব নয়। শোনার পর সে বিকল্প একটা প্রস্তাব দিল। সাদার্ন অ্যাভেনিউতে তার একটা বড় ফ্ল্যাট আছে। রোজ ঘন্টাখানেকের জন্যও যদি নয়নতারা একবার সেখানে যান সে কৃতার্থ হবে। নয়নতারা এ প্রস্তাবও নাকচ করে দিলেন।
এরপর উৎপাতের চেহারাটা বদলে যেতে লাগল। সেই সময় নয়নতারা যেসব ছবিতে সাইন করেছেন তার সবগুলোরই বেশির ভাগ শুটিং হচ্ছিল আউটডোরে। মাসের ভেতর পনের কুড়ি দিন বাইরে বাইরে কাটাতে হত। কখনও উটি, কখনও দার্জিলিং, নৈনিতাল বা জয়শলমীর। শুটিং স্পটগুলোর কাছাকাছি কোনো হোটেলে থাকতেন। যখন যে হোটেলেই উঠুন, দেখা যেত, তার পাশের সুইটটি দখল করে আছে সেই নেতাটি। কিভাবে যে তার আউটডোরে যাবার খবর জোগাড় করত কে জানে।
দিনের বেলা যেন নয়নতারাকে চেনে না, এমন একটা ভান করত লোকটা কিন্তু রাত্তিরে হোটেলটা ঘুমিয়ে পড়লে দরজায় ধাক্কা দিত। জীবন একেবারে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল সে।
প্রথম দিকে ঐরকম ইনফ্লুয়েন্সিয়াল পলিটিক্যাল লিডারের বিরুদ্ধে কড়া স্টেপ নেবার কথা ভাবতেও সাহস হচ্ছিল না নয়নতারার। লোকটা তাঁর ক্ষতি করে দিতে পারে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য তিনি মরিয়া হয়ে উঠলেন।
নয়নতারা বলেন, আত্মরক্ষার জন্যে এ ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না। কী করলাম জানো?
রণিতারা কিছু বলার আগে ফোন বেজে ওঠে। সেটা তুলে নয়নতারা বলে যান, হ্যাঁ, যা ওষুধ লাগে কিনে দিও… সাতাশ নম্বর ওই বস্তির স্কুলটার জন্যে সব চেয়ার টেবল আমি কিনে দেবো… হ্যাঁ, চিন্তা করো না।
এর আগেও একদিন কাকে যেন এভাবে আশ্বস্ত করেছিলেন নয়নতারা। তার যে নানাম গোপন দান ধ্যান আছে, এতদিনে তা জেনে গেছে রণিতারা।
কথাবার্তা শেষ করে নয়নতাবা টেলিফোন নামিয়ে রাখতে রাখতে বলেন, যা বলছিলাম– একদিন দার্জিলিংয়ের এক হোটলে লোকটা মাঝরাতে যখন দরজায় টোকা দিল, আমি দরজা খুলে সোজা তাকে ভেতরে ঢুকিয়ে নিলাম।
রণিতা এবং অমিতেশ চমকে ওঠে, বলেন কী!
ইয়েস– আস্তে মাথা নাড়েন নয়নতারা।
তারপর– শিবদাঁড় টান টান করে বসে রণিতারা।
মজার গলায় নয়নতারা প্রশ্ন করেন, তারপর কী হতে পারে অনুমান করতে পার?
খানিক চিন্তা করে রণিতা আর অমিতেশ একসঙ্গে বলে ওঠে, না।
নেতাটিকে বললাম, আর একবার বিরক্ত করলে কলকাতায় ফিরে প্রেম কনফারেন্স করে তার স্বরূপটি জানিয়ে দেব। শুধু তাই না, যে কনস্টিটিউয়েন্সি থেকে ভোটে দাঁড়াবে সেখানে মিনিমাম দশটা মিটিং করে সবাইকে জিজ্ঞেস করব, এইরকম দুশ্চরিত্র লম্পটকে কি আপনাদের প্রতিনিধি করতে চান? শুনে ভীষণ নার্ভাস হয়ে গেল লোকটা। সে আমার পপুলারিটির কথা জানে। আমি পাবলিক মিটিংয়ে দাঁড়িয়ে কিছু বললে সেটা ওর পক্ষে মারাত্মক হবে। একজন ফিল্ম অ্যাকট্রেসের চাইতে পলিটিকাল পাওয়ার যে অনেক বেশি লাভজনক সেটা বোঝার মতো বুদ্ধি ওর ছিল। ফলে–
ফলে কী?
একটি কথাও না বলে ল্যাজ গুটিয়ে আমার সুইট থেকে পালাল। পরের দিন ঘুম থেকে ওঠার পর শুনলাম দার্জিলিং থেকেই সরে পড়েছে।
পরে আর আপনাকে ফোন টোন করে নি?
নেভার।
দেখা হয় নি?
মনে পড়ছে না। বোধ হয় না।
রণিতা হাসতে হাসতে বলে, নেতাটিকে দারুণ ওষুধ দিয়েছিলেন তো?
তা দিয়েছিলাম। নয়নতারাও হাসতে থাকেন।
একটু চুপচাপ।
তারপর নয়নতারা বলেন, নেতাটিকে নিয়ে যা যা ঘটেছে সব তোমাদের বললাম। অথচ লোকে ব্যাপারটাকে ডিসটর্ট করে, নানা রকম রং চড়িয়ে এমন একটা রগরগে স্ক্যান্ডাল তৈরি করেছিল যেন লোকটার সঙ্গে শোওয়া ছাড়া জীবনে আমার আর আর কোনো উদ্দেশ্য নেই।
রণিতারা উত্তর দেয় না।
নয়নতারা এবার বলেন, যাদের সঙ্গে আমার নাম জড়িয়ে স্ক্যান্ডাল রটেছে, কিংবা যাদের সঙ্গে ইমোশানাল সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তাদের সবার কথাই বলা হল। আমি কিন্তু কিছুই লুকোই নি। আশা করি, তোমাদের ডকু-ফিচারের জন্যে গরম কিছু মেটিরিয়াল পেয়ে গেলে। বলে এক চোখ টিপে হাসলেন। তাঁর হাসিটি ফিচলেমিতে ভরা।
অমিতেশ এতক্ষণ একটি কথাও বলে নি। সামনের দিকে ঝুঁকে সে চাপা গলায় বলে, প্রায় সবার কথাই বলেছেন, শুধু একজন বাদ।