তবে এ বিয়েটা হল না কেন?
আমার দিক থেকে অসুবিধে ছিল না। তখন আমি একেবারে মুক্ত। আমরা মনে মনে তৈরিও হচ্ছিলাম, কিন্তু–
কী?
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন না নয়নতারা। ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে বাঁ ধারের জানলা দিয়ে বাইরের আকাশের দিকে তাকালেন। সেখানে অদৃশ্য টিভির পর্দায় যেন তার ফেলে আসা জীবনের কিছু ছবি ফুটে উঠতে থাকে। আকাশে চোখ রেখেই বলেন, একদিন দুপুরবেলা একজন বিধবা বয়স্কা মহিলা একটি শ্যামলা রঙের সুশ্রী বিবাহিত তরুণীকে নিয়ে আমার ফ্ল্যাটে এসে হাজির। বিধবামহিলাটি প্রথমে নিজেদের পরিচয় দিলেন। তিনি প্রশান্তর মা, আর তরুণীটি তার স্ত্রী। স্ত্রীর নাম অমলা। এভাবে যে তারা আসবেন, ভাবতে পারি নি, তাছাড়া প্রশান্তর যে বিবাহিত, আমার জানা ছিল না। একেবারে হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। যাই হোক, খানিকটা সামলে নিয়ে ওদের আসার উদ্দেশ্যটা জানতে চাইলাম। প্রশান্তর মা আমার দুহাত ধরে বললেন, অমলার মা বাবা নেই, মামার কাছে মানুষ এবং সে বোবা এবংকালা এটা গোপন রেখে তার সঙ্গে প্রশান্তর মামাশ্বশুররা ওর বিয়ে দেয়। যখন প্রতারণাটা ধরা পড়ে প্রশান্ত স্ত্রীর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখে না। স্বাভাবিক কারণেই দাম্পত্য জীবনে সে ঘোর অসুখী। কিন্তু অমলা খুবই ভাল মেয়ে। তার যেমন মায়া-মমতা তেমনি কর্তব্যবোধ। এখন যদি প্রশান্ত নয়নতারাকে বিয়ে করে, আইন অনুযায়ী অমলাকে ডিভোর্স করতে হবে। বিবাহ বিচ্ছেদ হলে মামার সংসারে জায়গা হবে না তার, প্রশান্তদের বাড়িতেও থাকা সম্ভব হবে না। কোথায় যাবে দুঃখী অসহায় মেয়েটা? প্রশান্তর মা আমার দুহাত জড়িয়ে ধরে বললেন, এই মেয়েটার জন্যে আমি আমার ছেলেকে তোমার কাছে ভিক্ষা চাইছি। লক্ষঈরলামমলার বড় বড় সরল নিষ্পাপ চোখ দুটো জলে ভরে গেছে। আমার বুকের ভেতরটা ভেঙেচুরে তছনছহয়ে যাচ্ছিল।তবু প্রাণপণে নিজেকে সংযত করে বললাম, আমার সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত থাকুন। আপনার ছেলে অমলারই থাকবে। আমাকে প্রচুর আশীর্বাদ করে ভদ্রমহিলা পুত্রবধূকে নিয়ে চলে গেলেন। সেই মুহূর্ত থেকে প্রশান্তর সঙ্গে আমার সম্পর্ক আর রইল না।
এরপর ঘরের ভেতর অদ্ভুত স্তব্ধতা নেমে আসে।
অনেকক্ষণ পর চোখ দুটো আবার হল-ঘরে ফিরিয়ে আনেন নয়নতারা। মলিন একটু হাসি ফোটে তার মুখে। বলেন, আশা করি প্রশান্তর সঙ্গে আমার বিয়ে না হওয়ার একটা স্যাটিসফ্যাক্টরি ব্যাখ্যা দিতে পেরেছি।
বিমর্ষ সুরে রণিতা জিজ্ঞেস করে, আপনার সঙ্গে প্রশান্ত ঘোষালের আর দেখা হয় নি?
হবে না কেন? তার সঙ্গে এরপর কত ছবিতে কাজ করেছি, দেখা তো হবেই। এক ছবিতে কাজ না করলেও স্টুডিওতে তো যেতে হত। দেখতাম ও অন্য ছবির কাজ করছে।
বিয়ে নিয়ে কোনো কথা হত না?
আমি বলে দিয়েছিলাম, বন্ধুত্ব ছাড়া আমাদের ভেতর আর কোনো সম্পর্ক থাকা উচিত না। আগেই বলেছি, প্রশান্ত ভদ্রলোক, আমার কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলত। আমার ফ্ল্যাটে কখনও আসত না। টেলিফোনে অবশ্য খোঁজখবর নিত, কোনো দরকার আছে কিনা জিজ্ঞেস করত।
এখনও কি ওঁর সঙ্গে কথাবার্তা হয়?
না। আট বছর আগে স্টেজ আর ফিল্ম ছেড়ে দিলাম, তারপর আর কারো সঙ্গে যোগাযোগ রাখি নি।
এবার কিছুক্ষণ চুপচাপ।
নয়নতারা গভীর ঘোরে যেন ডুবে থাকেন। কতক্ষণ কেটে যায় কারো খেয়াল থাকে না।
একসময় নয়নতারা আচ্ছন্নতার ভেতর থেকে নিজেকে তুলে আনেন। ঘোরটা অনেকখানি কেটে গেছে। কিছুটা তরল গলায় বলেন, আমার আর কোনো অ্যাফেয়ার নিয়ে প্রশ্ন আছে?
আছে।
যথা–
রণিতা বলে, শুনেছি একজন পলিটিক্যাল লিডার এক সময় আপনাকে খুব জ্বালিয়েছিল।
নয়নতারা হাসতে হাসতে বলেন, ওহ, এত খবরও জোগাড় করেছ। ফিল্মমেকার না হয়ে তোমার ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টে যাওয়া উচিত ছিল।
রণিতা হাসে। বলে, যা বলেছেন, আপনার সম্পর্কে মেটিরিয়াল জোগাড় করতে গিয়ে আমাকে একজন ছোটখাট শার্লক হোমস হতে হয়েছে। এবার জননেতাটির কথা বলুন–
নয়নতারা বলেন, একজন না, দুজন পলিটিক্যাল লিডার। রমাপতি সরমেল আর জ্যোতিষ বটব্যাল।
রণিতা বলে, রমাপতির কথা ডিটেল কাগজে পড়েছি। কিন্তু জ্যোতিষ বটব্যাল সম্পর্কে কিছুই জানি না। যদি এর সম্বন্ধে বলেন–
নয়নতারা বলেন, এরকম স্কাউড্রেল আমার জীবনে খুব কমই দেখেছি। একেবারে দু-কান কাটা, নির্লজ্জ। আগে নাম-করা মাস্তান ছিল, একজন এম.পির হয়ে মারদাঙ্গা করত, ছাপ্পা ভোট দিত, বুথ জ্যাম করে তার স্যারকে জেতাবার ব্যবস্থা করত। এসব করতে করতে তার তৃতীয় নয়ন খুলে গেল। এই কৌশলে যদি ইলেকশানে জেতা যায় তা হলে সে দোষটা করল কী? কিছু মাসল পাওয়ার, কয়েকটা রাইফেল, কিছু বোমা, এসব তো তার হাতে আছেই, অতএব ভোট পাওয়াটা এমন কী ব্যাপার? নয়নতারা বলতে থাকেন, ব্যাকগ্রাউন্ডটা সাতকাহন করে বলছি, তার কারণ লোকটাকে বুঝতে সুবিধে হবে।
রণিতা বলে, হা হা, বলুন। ভেরি ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার।
নয়নতারা ফের শুরু করেন, তা ছাড়া মস্তানদের লোকে ভয় পেলেও মনে মনে ঘৃণা করে। কিন্তু রাজনৈতিক নেতা হতে পারলে মানুষ খাতির করে, স্যালুট পাওয়া যায়, সামাজিক প্রতিপত্তি বাড়ে। লোকটা অতএব পলিটিকসে এসে গেল। পলিটিকসের চেয়ে বড় বিজনেস তো আর নেই। আমি সবার কথা বলছি না, তবে বেশির ভাগই একবার এম এল এ, এম পি বা মন্ত্রী-টন্ত্রী হতে পারলে নিচের চোদ্দ পুরুষ নবাবের হালে থাকার ব্যবস্থা করে নেয়। এই লোকটি মস্তানি ছেড়ে দিল। তার নিজস্ব একটা বাহিনী ছিল। তারাই তার হয়ে ইলেকশানে খাটল। পুরনো বদনাম ঘুচিয়ে ভাল একটা ইমেজ তৈরি করার জন্যে নিজেকে পুরোপুরি পালটে ফেলল সে। শুধু বন্দুক দিয়ে খানিকটা ভোট টানা যায়, ইলেকশান পুরোপুরি জেতা যায় না। তার জন্যে আলাদা কৌশল দরকার। সবচেয়ে ভাল হয়। যদি একটা সোসাল ওয়ার্কার অর্থাৎ সমাজসেবীর ইমেজ তৈরি করা যায়। ভবিষ্যতের জন্যে ছক কেটে এগুতে লাগল সে। মোটা টাকা চাঁদা দিয়ে তার এলাকার অনেকগুলো পুজো কমিটির প্রেসিডেন্ট হয়ে বসল। পটাপট কটা টিউবওয়েল বসাবার ব্যবস্থা করল, বস্তির কয়েকটি দুঃস্থ মেয়ের বিয়ে দিল। ক্লাবে ক্লাবে ফুটবল, ভলিবল, ব্যাডমিন্টনের সরঞ্জাম কিনে দিল। অনেকটা রবিন হুডের মতো ব্যাপার।