রণিতারা চুপ।
নয়নতারা বলেন, তোমাকে যা বললাম তার একটা শব্দও বাদ দেবে না।
রণিতা হঠাৎ জিজ্ঞেস করে, ঐ কুড়িজন কারা?
নয়নতারা চোখ বুজে ঠোঁট টিপে কী ভাবেন। তারপর বলেন, সেটা এখন বলছি না।
কেন?
এদের ছেলেমেয়ে নাতি-নাতনিরা রয়েছে। তারা ওদের ঘৃণা করুক, ওদের পারিবারিক শান্তি নষ্ট হোক, সেটা আমি চাইছি না। তবে এই লোকগুলোর নাম এবং কখন কিভাবে ওরা আমার শরীর নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে রেকর্ড হিসেবে সব একটা ডায়েরিতে লিখে রেখেছি। আমি ওগুলো প্রকাশ করতে চাই না। আমার মত্যুর পর কারো হাতে ডায়েরিগুলো পড়লে কী হবে, জানি না।
রণিতারা কোনো প্রশ্ন করে না, একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে।
নয়নতারা একটানা বলে যান, হয়তো কোনোদিন সেসব প্রকাশ হয়ে পড়বে, হয়তো বা গোপনই থেকে যাবে।
রণিতা হঠাৎ বলে ওঠে, যে কুড়ি জনের কথা বললেন, আপনি নাম করার পর তাদের সঙ্গে আর কি দেখা হয়েছে?
ফিল্ম ওয়ার্ডে তারপরও এতকাল কাটিয়ে দিলাম, দেখা হবে না?
সেই সময় আপনার সঙ্গে ওদের ব্যবহারটা কেমন ছিল?
প্রশ্নটা ঘুরিয়ে করলে ভাল হয়। ওদের না, আমার ব্যবহার কেমন ছিল। ঐসব বাস্টার্ডদের সঙ্গে রাস্তার কুকুরের মতো ব্যবহার করতাম। আমি যে ছবিতে নামতাম তখন সেটা সুপার ডুপার হিট হয়ে যেত। মিনিমাম ফুল হাউস-এ গোল্ডেন জুবিলি তো হতই। ঐ লোকগুলো এসে লিটারেলি আমার পায়ে ধরত, তাদের ছবিতে যদি দয়া করে অভিনয় করি। আমাকে নামাতে পারলে সিওর বক্স অফিস সাকসেস।
আপনি নামতেন ওদের ছবিতে!
হাঁ, নামতাম।
অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে রণিতারা।
নয়নতারা বলেন, একশবার ঘুরিয়ে, ফ্যাবুলাস অ্যামাউন্ট নিয়ে ছবিতে সাইন করতাম। শুটিংয়ের সময় যত ভাবে পারি ট্রাবল দিয়েছি। এক শিফটে যেখানে আট ঘন্টা কাজ করার কথা সেখানে আধ ঘন্টা কাজ করেছি। দিনের পর দিন শুটিং করতে যাই নি। মেক-আপ নেবার পর মুড নেই বলে বাড়ি চলে এসেছি। কাউকে কাউকে দিয়ে জুতোর স্ট্র্যাপ পর্যন্ত বাঁধিয়ে ছেড়েছি। প্রতি মোমেন্টে বুঝিয়ে দিয়েছি, পুরনো কথা ভুলি নি।
রণিতা বলে, এতে তো ওদের ক্ষতি হয়েছে।
অবশ্যই হয়েছে। আর সেটাই তো আমি চাইতাম। কিন্তু ব্যাপারটা কি জানো, প্রতিটা ছবিই বক্স অফিসে সাকসেস পেয়েছে।
রিভেঞ্জটা তা হলে ওভাবে নিয়েছেন?
তা একরকম বলতে পার।
রণিতা জিজ্ঞেস করে, নাম করার পর কেউ আর সুযোগ নিতে চেষ্টা কবে নি?
নয়নতারা বলেন, কোনো শুয়ারের বাচ্চাকে পা ছাড়া শরীরের অন্য কোথাও হাত দিতে দিই নি।
মহিলার ক্রোধ এবং আক্রোশ যে এতদিন বাদেও কত তীব্র আকারে জমা হয়ে আছে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না রণিতার। সে বলে, আপনার স্বামী যখন মারা যান, আপনার বয়স তখন আর কত, খুব বেশি হলে তিরিশ টিরিশ
হ্যাঁ, ঐ রকমই হবে।
সেই সময় কারও সঙ্গে ইমোশানাল অ্যাটাচমেন্ট কিছু হয় নি?
একটা চোখ ছোট করে নয়নতারা বলেন, তার মানে প্রেম করেছি কিনা জানতে চাইছ?
রণিতা বলে, হ্যাঁ। দুজন হিরোর সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। তারা তো বলেন–
তাকে থামিয়ে দিয়ে নয়নতারা বলেন, অমলকুমার আর চিরঞ্জীবের কথা বলছ নিশ্চয়ই?
হ্যাঁ।
পঁচিশ তিরিশ বছর আগেই ওদের বাজার শেষ হয়ে গেছে। আমাকে নিয়ে যখন ক্রেজ চলছে, ওদের তখন আর তেমন ডিমাণ্ড নেই। হিরো হবার অফার ওরা তখন পেত না বললেই হয়। দাদা, কাকা কি অন্য কোনো ক্যারেক্টার রোলেই বেশি নামত। আজকাল তো লোকে ওদের প্রায় ভুলেই গেছে। মাঝে মাঝে কাগজে দেখি অমলকুমার আমাকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে কিছু কিছু স্ক্যাণ্ডাল বানিয়ে বাজারে ছাড়ে। সব বেসলেস, মিথ্যে। আসলে পাবলিসিটি হোক, ওর নাম নতুন করে লোকের মনে পড়ুক, খুব সম্ভব এটাই সে চায়। আমি আর কী করতে পারি বল। মনে মনে শুধু হাসি। তবে চিরঞ্জীব ঐ ধরনের নয়।
হঠাৎ অন্য একজন হিবোর কথা মনে পড়ে রণিতার। মাত্র কদিন আগে এর কথা জানতে পেরেছে সে। জিজ্ঞেস করে, আর প্রশান্ত ঘোষাল?
একটু চুপ করে থাকেন নয়নতারা। তারপর ধীরে ধীরে বলেন, হি ইজ আ পারফেক্ট জেন্টলম্যান। কালচারড, ডিসেন্ট। আমার ওপর তিনি খুবই সিমপ্যাথেটিক। স্বীকার করছি ওঁর সঙ্গে আমার একটা ইমোশানাল অ্যাটাচমেন্ট ঘটেছিল। আমরা পরস্পরকে ভালবেসেছিলাম। রুচি এবং মানসিকতার দিক থেকে আমাদের যথেষ্ট মিল ছিল।
রণিতা জিজ্ঞেস করে, তখন কি আপনার স্বামী জীবিত ছিলেন?
না।
তা হলে বিয়ে করে আপনারা একসঙ্গে থাকলেন না কেন? এটা একটা আইডিয়াল ম্যারেজ হতে পারত।
এই বিয়েটা না হওয়ায় নয়নতারা যে একদিন ভেঙে পড়েছিলেন, সেই হতাশা যে এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেন নি, তাঁর মুখচোখ দেখে সেটা টের পাওয়া গেল। জোরে শ্বাস টেনে বিষণ্ণ সুরে বলেন, তার উপায় ছিল না।
রণিতা বলে, কেন?
সে অনেক কথা–
প্লিজ বলুন।
নয়নতারা আর আপত্তি করলেন না। ব্যক্তিগত যে ইতিহাস দীর্ঘকাল সঙ্গোপনে ছিল তা প্রকাশ করার জন্য অদ্ভুত এক ব্যাকুলতা হয়তো ভেতরে ভেতরে তীব্র হচ্ছিল। রণিতাদের মতো সহৃদয় শ্রোতা পেয়ে প্রবল উচ্ছ্বাসে তা বেরিয়ে আসতে লাগল।
নয়নতারা বলেন আজ আর কনফেস করতে দ্বিধা নেই, শুধু ভালবাসা নয়, আমরা পরস্পরকে পাওয়ার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিলাম। নিজের স্বামীকে যে ভালবাসিনি, তা নয়। সেটা বোধহয় সামাজিক সংস্কার পালনের জন্য। সমাজে দশজনের মধ্যে থাকতে গেলে স্বামীকে ভালবাসতে হয়, সেই নিয়মটা পালন করে গেছি। তবে এটা ঠিক, অনেক দিন এক সঙ্গে থাকলে মানসিক একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আমার স্বামী মানুষটা খারাপ ছিল না, ওর ওপর কেমন একটা মায়াও পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু সত্যিকারের প্রেমটা যে কী, তা প্রশান্তর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবার পর বুঝতে পারলাম। কেউ কাউকে ছেড়ে থাকতে পারতাম না। মাঝে মাঝেই আমরা কলকাতা থেকে দূরে কোথাও চলে যেতাম। এই নিয়ে সে আমলে মিডিয়াগুলোতে কিছু স্ক্যাণ্ডাল রটেছে, আমরা গ্রাহ্য করতাম না। টালিগঞ্জের স্টুডিওপাড়ায় আমাদের নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড চলত। তবে সামনাসামনি কারো কিছু বলার সাহস ছিল না। কেননা আমরা যে ছবিতে নামতাম তা পয়সা দিত। কে কী বলবে? অকপটে বলছি, ওর সঙ্গে আমার দৈহিক সম্পর্কও ছিল।