জীবন সংগ্রাম বলে একটা কথা আছে। তার চেহারা যে কতটা মারাত্মক, এবার সেটা টের পেতে থাকেন লক্ষ্মীরা। তাঁর স্বামী গ্র্যাজুয়েট হওয়ায় একটা কেরানির চাকরি জুটে গেল। তাঁর অন্য ভাইরা এবং শ্বশুর হন্যে হয়ে সারা শহর তোলপাড় করে ফেলতে লাগলেন কিন্তু দশ টাকার একটা কাজও জোগাড় করতে পারলেন না। অথচ বেঁচে তো থাকতে হবে। একজনের সামান্য কেরানির চাকরি সংসারের এতগুলো লোককে তো বাঁচাতে পারে না। তাই লক্ষ্মীকেই অন্য ব্যবস্থা করতে হয়েছিল।
কলকাতায় এসে প্রথমে কালিঘাটে উঠেছিলেন তাঁরা। তাঁদের পাশাপাশি থাকত ফিল্মের একজন অ্যাসিস্টান্ট ডিরেক্টর বিনয় ধর। লক্ষ্মীদের অবস্থা দেখে সে ফিল্মে ওঁর কাজ করার সুযোগ করে দেয়।
নয়নতারা বলেন, এর পরের ইতিহাস কারো অজানা নেই। আশা করি তোমরাও জেনে গেছ।
রণিতা বলে, হাঁ। তবু দু-একটা প্রশ্ন আছে।
বল–
আমরা যেটুকু ইনফরমেশন পেয়েছি তাতে জানতে পেরেছি, আপনাদের ফ্যামিলি ছিল ভীষণ কনজারভেটিভ। তাঁরা আপনার ফিল্মে নামাটা যে ভালভাবে নেয়নি, সেটাও আমাদের জানা আছে। কিন্তু আপনার স্বামীর রি-অ্যাকশান কোথাও পাই নি।
নয়নতারা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। তারপর ধীরে ধীরে জানান, তাঁর স্বামী ছিলেন ভাল মানুষ, নিরীহ টাইপের এবং ভীষণ চাপা। মুখে কিছু না বললেও তিনি যে খুব কষ্ট পেয়েছিলেন সেটা স্পষ্ট বোঝা যেত। আসলে পুরুষ মানুষের গোপন অহঙ্কার ছিল তাঁর মধ্যে। স্বামী হয়ে লক্ষ্মীর ভরণ পোষণ করতে পারছেন না, বরং লক্ষ্মীই তাঁদের পরিবারে অন্ন জোগাচ্ছেন, এটাই তাঁকে ভেতরে ভেতরে শেষ করে দিয়েছিল।
অমিতেশ জিজ্ঞেস করে, ওঁর সঙ্গে এই নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি, তর্কাতর্কি হয়েছে?
একেবারেই না। ও একেবারে চুপ হয়ে গিয়েছিল।
রণিতা বলে, শুনেছি, সিক্সটিজের গোড়ার দিকে আপনি শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে গলফ ক্লাব রোডের একটা বাড়িতে একাই চলে গিয়েছিলেন। আপনার স্বামী আসেন নি কেন?
নয়নতারা বলেন, ও ছিল পুরনো ধ্যানধারণার মানুষ। স্ত্রীর জন্যে মা বাবাকে ছাড়তে রাজি হয়নি।
অমিতেশ মজার গলায় বলে, রামচন্দ্রের মডার্ন সংস্করণ।
নয়নতারা উত্তর দিলেন না।
রণিতা জিজ্ঞেস করে, শশুরবাড়িতে থাকলেন না কেন?
থাকা গেল না।
কারণটা কী?
আমার নাম হচ্ছিল। সোসাইটির ভি আই পিদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ পাচ্ছিলাম। তাঁদের ধরে দেওরদের, এমন কি শ্বশুরেরও চাকরি করে দিয়েছি, ননদের এমন ছেলের সঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থা করেছি যা ওরা কল্পনাও করতে পারত না। নতুন একখানা বাড়িও করে দিলাম। তবু ওরা আমার সঙ্গে ভীষণ খারাপ ব্যবহার করতে লাগল। প্রোডিউসর ডিরেক্টররা তখন লাইন দিয়ে বাড়িতে আসছে, তাদেরও নানাভাবে অপমান করত।
আশ্চর্য! আপনার কাছে তো ওদের আজীবন কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।
নয়নতারার মুখে মলিন একটু হাসি ফোটে। তিনি বলেন, আশ্চর্য হবার কিছু নেই। এটা ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স হীনম্মন্যতা। ঘরের বউয়ের গাদা গাদা
ছবি বেরুচ্ছে খবরের কাগজে, ম্যাগাজিনে, সারা শহর জুড়ে তার কাট আউট, তার মুখ দিয়ে পোস্টার, হোর্ডিং। এত নাম তার, অজস্র টাকা আনছে সে, তার দয়ায় সবার চাকরি হয়েছে– এসব কি মেনে নেওয়া যায়! হিউম্যান নেচার একটা বিচিত্র জিনিস।
কিছুদিন আগে নয়নতারার খোঁজে তাঁর শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিল রণিতারা। তার দেওর তাদের সঙ্গে জঘন্য ব্যবহার করে। হেতুটা এতদিনে পরিষ্কার হয়ে যায়। কয়েক পলক কী ভেবে রণিতা বলে, একটা কথা জিজ্ঞেস করলে কিছু মনে করবেন না?
মনে করার মতো আশা করি কোনো প্রশ্ন করবে না।
শুনেই দেখুন না—
নয়নতারা উৎসুক চোখে তাকিয়ে থাকেন।
আপনি একজন হাউস ওয়াইফ। ফ্যামিলি পিসের জন্য ফিল্মটা তো ছেড়ে দিতে পারতেন।
বাঘের পিঠে কখনও চড়েছ?
না, মানে–
নয়নতারা গম্ভীর গলায় বলেন, চড়লে আর নামা যায় না। আমিও তেমনি সাকসেসের কাঁধে তখন চেপেছি। গ্ল্যামার, টাকা, নাম– এসব ছাড়ার কথা ভাবতেও পারতাম না, অদ্ভুত এক ঘোরের মধ্যে তখন ছুটছি।
একটু চুপ।
তারপর রণিতা বলে, শুনেছি, আপনার সঙ্গে আপনার স্বামীর সম্পর্ক শেষ দিকে আর ছিল না।
নয়নতারা বলেন, ঠিকই শুনেছ।
ডিভোর্স হয়েছিল কি?
না। তবে ডিভোর্সের চাইতে ভাল কিছুও তো হয়নি। বলতে বলতে একটু থামেননয়নতারা।মুখ নামিয়ে চাপাবিষণ্ণসুরে বলেন, তারপর তোওমারাই গেল। আমাকে না জানিয়ে ওকে শ্মশানে নিয়ে গিয়েছিল। খবর পেয়ে ছুটলাম। শ্বশুরবাড়ির লোকেরা আমাকে কাছে যেতে দিল না, কুৎসিত গালাগাল করতে লাগল। এদিকে আমাকে দেখে প্রচুর ভিড় জমে গিয়েছিল। কী বিশ্রী সিচুয়েশন ভেবে দেখ। নিরুপায় হয়ে পালিয়ে এলাম। স্বামীকে শেষ দেখাটাও ওরা দেখতে দিল না।
এরপর অনেকক্ষণ কেউ কিছু বলে না। দোতলার এই বিশাল ঘরে গাঢ় স্তব্ধতা নেমে আসে।
কতজনের সঙ্গে আমাকে শুতে হয়েছে? নয়নতারা মনে মনে হিসেব করে বলেন, টোয়েন্টি– ইয়েস কুড়ি জন।
রণিতা চমকে ওঠে। রুদ্ধ স্বরে জিজ্ঞেস করে, আপনি যা বললেন তা কি ডকু-ফিচারে ইউজ করতে পারি?
এক মুহূর্তও চিন্তা করলেন না নয়নতারা। বললেন, নিশ্চয়ই। আমাদের দেশের বায়োগ্রাফি বা অটোবায়োগ্রাফিগুলোতে এত মিথ্যে বা হাফ-টুথ থাকে যে তাকে কোনোভাবেই নিখুঁত বলা যায় না। বিখ্যাত পুরুষ হলে তাকে দেবতা, আর মহিলা হলে তাকে দেবী বানাবার চেষ্টা। আরে বাবা, দোষত্রুটি ভালমন্দ মিশিয়েই তো মানুষ, সাদাকালো নিয়েই জীবনের ড্রামা। কেউ কেউ পরিস্থিতির শিকার হয়ে যায়, যেমন আমি হয়েছিলাম। ব্ল্যাক সাইডটা বাদ দিলে লাইফ তো ম্যাড়মেড়ে, ওয়ান-ডাইমেনশানাল হয়ে যায়। তার কি কোনো চার্ম থাকে?