সবই বুঝলাম কিন্তু নয়নতারাকে পাচ্ছি কোথায়?
এনিহোয়ার ইন হেভেন অ্যান্ড আর্থ। চারদিক চষে ফেল। মৃত্যুর খবর যখন এতদিন পাওয়া যায়নি তখন কোথাও না কোথাও তিনি আছেন।
রণিতা কিছু বলে না।
আচমকা যেন সব মুশকিলের আসান হয়ে গেছে এমন উল্লসিত সুরে চেঁচিয়ে ওঠে রজনী, আরে বাঃ, তোর হাতে এমন একটা সুপার হিরো রয়েছে। ওই শালেকে নয়নতারার পেছনে লাগিয়ে দে। কাম হো যায়েগা। বলে গলা নামিয়ে অতীব মধুর স্বরে কটি চোস্ত ইংরেজি খিস্তি আওড়ায়। সেগুলো অশ্লীল হলেও বেশ মুখরোচক।
রজনীর মুখে কিছুই আটকায় না। হিন্দি বাংলা ইংরেজি গুজরাটি মারাঠি সিন্ধি, মোট কথা ভারতীয় প্রজাতন্ত্রে যতগুলো চালু ভাষা আছে তার বাছা বাছা কিছু গালাগাল তার কণ্ঠস্থ। চার অক্ষরের একটা অস্বস্তিকর ইংরেজি শব্দ আকছার তার মুখে শোনা যায়। পুনেতে কোর্স করার সময় বাৎস্যায়নের কামসূত্র থেকে এখনকার ফ্রি সেক্স নিয়ে ছেলে-বন্ধুদের সঙ্গে এমন হৈ চৈ বাধিয়ে দিত যে রণিতার মতো স্মার্ট মেয়েরও কান লাল হয়ে উঠত।
সুপার হিরো বা শালেটা কে বুঝতে না পেরে রণিতা জিজ্ঞেস করে, কার কথা বলছিস?
তোর সেই ব্লডি হেল বয়ফ্রেন্ড-ওই যে নিউজপেপারের রোভিং রিপোর্টার। কী যেন নাম? কী যেন–
এবার বোঝা গেল, অমিতেশের কথা বলছে রজনী। রণিতা যখন ফাস্ট ইয়ারে, অমিতেশের তখন থার্ড ইয়ার। প্রেমটা ওই কলেজের সময় থেকেই। পুনেতে যাবার পর রজনীর সঙ্গে যখন দারুণ বন্ধুত্ব হয়ে গেল, একদিন সারা রাত ধরে ওরা একজন আরেক জনকে তাদের প্রেমের গল্প শুনিয়েছিল। দেখা যাচ্ছে, অমিতেশের কথা রজনী ভোলেনি। রণিতাও মনে রেখেছে, একটি সিন্ধি যুবক, নাম কমল শিবদাসানি, কয়েক বছর ধরে রজনীর জন্য অপেক্ষা করে আছে। রণিতার মতো রজনীরও ধনুর্ভাঙা পণ, চোখ-ধাঁধানো কেরিয়ার না করা পর্যন্ত বিয়ে নয়।
রণিতা বলে, ওর নাম অমিতেশ–
রজনী বলে, রাইট। বুঝলি রণি, রিপোর্টাররা হল একেকটা শার্লক হোমস কি হারুকুল পয়নোর বাচ্চা। তোর ওই হারামজাদে ব্লাড-হাউন্ডের মতো গন্ধ শুঁকে শুঁকে ঠিক নয়নতারার কাছে পৌঁছে যাবে। লাভারের জন্যে লোকে লাইফ পর্যন্ত দিয়ে দেয়, আর এ তো একজন মহিলাকে খুঁজে বার করা। আজই ওর সঙ্গে কথা বলে নিবি। কী হল না হল, আমাকে তাড়াতাড়ি জানাস।
আচ্ছা—
এখন ছাড়ছি। ভেরি গুড লাক অ্যান্ড গুড নাইট।
গুড নাইট।
.
০২.
রণিতার মধ্যে একটি বেপরোয়া, অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয় মেজাজ রয়েছে। সেটাকে উসকে দিল রজনী। প্রাথমিক দ্বিধা এবং সংশয় কাটিয়ে সে ঠিক করে ফেলে নয়নতারাকে নিয়ে ডকু-ফিচারটা করতেই হবে। হঠাৎ তার আবছাভাবে মনে পড়ল, ওঁকে নিয়ে আগেও দু-একজন ছবির কথা ভেবেছিল কিন্তু বিশেষ কিছুই করে উঠতে পারেনি। অন্যেরা পারেনি বলে সে পারবে না, এমন কোনো কথা নেই। অন্তত চেষ্টা সে করে যাবে, তারপর দেখা যাক কত দূর কী হয়।
অমিতেশের ব্যাপারে রজনী খুব দামি একটা পরামর্শ দিয়েছে। নয়নতারাকে খুঁজে বার করতে হলে ওকে সবার আগে দরকার। তাছাড়া প্রিন্ট মিডিয়ার সাহায্যও ভীষণ জরুরি, অমিতেশ পাশে না থাকালে সেটা একেবারেই সম্ভব নয়।
আসলে নয়নতারার বেশ কিছু ফিল্ম দেখলেও তাঁর জীবন সম্পর্কে পরিষ্কারভাবে তেমন কিছু জানে না রণিতা। অথচ সলিড, সত্য কিছু ঘটনা জানা না থাকলে ডকু-ফিচারটা সাজাবে কী করে?
রণিতার মনে আছে, নয়নতারা যখন অভিনয়ের জগৎ থেকে ধীরে ধীরে নিজেকে সরিয়ে নিতে শুরু করেছেন তখন সবে এ দেশে টিভি এসেছে। আকাশবাণী বা দূরদর্শনের কোনো প্রোগ্রামে তাঁকে দেখা গেছে কি? কখনও কি টিভিতে ইন্টারভিউ দিয়েছেন? রণিতার মনে পড়ে না। যদি দিয়েও থাকেন, তার জানা নেই। অডিও-ভিসুয়াল মিডিয়ার কাছ থেকে বিশেষ কিছু তথ্য পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। তবু আকাশবাণী আর দূরদর্শন ভবনে গিয়ে সে খোঁজ নেবে।
নয়নতারার ব্যাপারে তাকে অনেকখানি নির্ভর করতে হবে প্রিন্ট মিডিয়ার ওপর। রণিতা জানে, নয়নতারার জীবন এবং অভিনয় নিয়ে গত চল্লিশ বছর ধরে প্রচুর লেখালিখি হয়েছে খবরের কাগজ আর ম্যাগাজিনগুলোতে। শুধু চকচকে রঙিন সিনেমা ম্যাগে নয়, নাক-উঁচু বিখ্যাত সব লিটল ম্যাগাজিনেও। এখনও, তাঁর নিরুদ্দেশ হবার এত বছর বাদেও তাঁর সম্বন্ধে মানুষের বিপুল আগ্রহ। ফিল্ম এবং স্টেজ সম্পর্কে কোথাও কোনো লেখা বেরুলে নয়নতারা প্রসঙ্গ এসে যাবেই।
অমিতেশদের দৈনিক দিনকাল-এর অফিসে চমৎকার একটা লাইব্রেরি আছে। সেখানে ওদের কাগজ তো বটেই, অন্য সব বড় বড় ডেইলিরও পঞ্চাশ বছরের ফাইল যত্ন করে রেখে দেওয়া হয়েছে। আর আছে অসংখা নামকরা ম্যাগাজিন আর নানা বিষয়ের ওপর দামি দামি রেফারেন্সের বই। নয়নতারা সম্পর্কে তথ্য জোগাড় করার জন্য এইসব পত্রপত্রিকা খুঁটিয়ে দেখা দরকার। কিন্তু লাইব্রেরি শুধুমাত্র দিনকাল-এর স্টাফের জন্য, সেখানে বাইরের কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয় না। এডিটরের কাছ থেকে রণিতার জন্য স্পেশাল পারমিশান এনে ওখানে কাগজপত্র দেখার ব্যবস্থা করে দিতে পারে অমিতেশই। এর আগেও কয়েক বার করে দিয়েছে। দুতিনটে ডকুমেন্টারির জন্য নানা দৈনিকের পুরনো কিছু রিপোর্ট দরকার হয়েছিল তার।
রজনী লাইন ছেড়ে দিয়েছিল। তারপরও কিন্তু ফোন-স্ট্যান্ডের কাছে দাঁড়িয়ে আছে রণিতা। নয়নতারার ব্যাপারটা মাথায় ঢুকবার পর ভেতরে ভেতরে এক ধরনের উত্তেজনা টের পাচ্ছে সে। আর কোনো কিছু তার মাথায় চাপলে শুরু না করা পর্যন্ত স্বস্তি নেই। অস্থিরতা এবং টেনশন ক্রমশ বাড়তেই থাকে। এখনই অমিতেশের সঙ্গে কথা বলা দরকার।