এদিকে অমিতেশ তৎপর হয়ে ওঠে। সে জানে নয়নতারার লেখার কোয়ালিটি যেমনই হোক তাঁর নামের মধ্যে একটা ম্যাজিক রয়েছে। ওঁর লেখা ছাপতে পারলে চারদিকে হই হই শুরু হবে, রাতারাতি কাগজের সার্কুলেশন অনেক বেড়ে যাবে। এমন সুবর্ণ সুযোগ ছাড়া যায় না। সে বলে, ডায়েরি লিখলে আমরা ইন্টারেস্টেড। ফার্স্ট অফারটা কিন্তু আমি দিয়ে রাখলাম। আপনার সব শর্ত মেনে ওটা ছাপাতে চাই। যদি বলেন অ্যাডভান্স অনারেরিয়াম কালই দিয়ে যাব।
নয়নতারা হাসেন, অত ব্যস্ত হতে হবে না। তবে এটুকু জেনে রাখো, ডায়েরি আমি লিখছি না।
যা-ই লিখুন আমরা তাই ছাপব।
ছাপার যোগ্য কিনা সেটা না জেনেই?
অমিতেশ বলে, আপনি যখন লিখেছেন তখন নিশ্চয়ই ভাল হবে।
নয়নতারা বলেন, আমার ওপর তোমার অগাধ আস্থা দেখছি। পরক্ষণে চোখ সরু করে, গলার স্বর অনেকখানি নামিয়ে ফের বলেন, নাকি আমার নামের গ্ল্যামারটা কাজে লাগাতে চাও?
অমিতেশ থতমত খেয়ে যায়। মহিলা যে দুর্দান্ত বুদ্ধিমতী তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। সে বলে, না না, মানে–
নয়নতারা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, তোমার অফার আমার মনে থাকবে। এখন দুজনে ইচ্ছে হলে কিছুক্ষণ রেস্ট নিতে পার।
রণিতা বলে, আপনি যখন লেখাপড়া করেন, সেই সময়কার কিছু ছবি নিতে চাই।
ডকু-ফিচারের জন্যে?
হ্যাঁ।
ঠিক আছে, পরে নিও।
নয়নতারা আর দাঁড়ান না, বড় বড় পা ফেলে চলে যান। রণিতারা ঠিক জানে না, তবে ওদের মনে হল, একতলার কোথাও বসে লেখাপড়ার কাজটা করেন নয়নতারা।
দুপুরে বিশ্রাম বা ঘুমনো টুমনো রণিতাদের ধাতে নেই। দোতলার হল-এ সোফায় গা এলিয়ে নয়নতারাকে নিয়ে আলোচনা করে করেই তারা তিনটে ঘণ্টা কাটিয়ে দিল।
.
১৯.
ঠিক চারটেতেই নয়নতারার সঙ্গে আবার দেখা হল রণিতাদের। সন্ধ্যাকে সঙ্গে নিয়ে একতলা থেকে তিনি ওপরে উঠে এলেন। সন্ধ্যার হাতে একটা বড় ট্রেতে চায়ের সরঞ্জাম, কটা কেক, কিছু বিস্কুট এবং সন্দেশ।
মহিলা যে অত্যন্ত সময়ানুবর্তী, ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে তাঁর চলাফেরা, ঘুম বিশ্রাম, শ্লোকপাঠ, একদিনেই এসব টের পেয়ে গেছে রণিতারা।
ট্রে রেখে চলে যায় সন্ধ্যা। নয়নতারা চা তৈরি করে রণিতাদের দিয়ে নিজে এক কাপ নেন, তারপর জিজ্ঞেস করেন, সারাদিন বাড়ির ভেতর থেকে থেকে খুব একঘেয়ে লাগেছে, না?
রণিতা বলে, না না, একেবারেই না। আমরা বরং আপনাকে নানা দিক থেকে দেখার সুযোগ পাচ্ছি।
জিভের ডগায় চুক চুক আওয়াজ করে ফিচেল ধরনের একটু হাসেন নয়নতারা। মজার গলায় বলেন, কোথায় দুজনে চুটিয়ে প্রেম করে বেড়াবে, তা নয়। আমার মতো এক বৃদ্ধার পেছনে ঘুর ঘুর করছ। কোনো মানে হয়? কদিন এখানে যাওয়া-আসা করলে একেবারে বুড়িয়ে যাবে।
কথাগুলো যে নিছক মজা করার জন্যই বলা তা বুঝতে পারছিল রণিতারা। তারা শুধু হাসে।
নয়নতারা আবার বলেন, আমাদের ইস্ট বেঙ্গলে একটা কথা ছিল–সঙ্গ দোষে রং ধরে। আমার সঙ্গে থেকে থেকে একদিন দেখবে চোখে ক্যাটার্যাক্ট, হাঁটুতে আর্থারাইটিস, এই সব ধরিয়ে ফেলেছ।
রণিতারা হাসতেই থাকে। নয়নতারা কপট হতাশার একটা ভঙ্গি করে বলেন, যাক, আমার বার্ধক্যটা যখন শেয়ার করতেই চাও তখন আর বলার কিছু নেই। এবার বল এখন তোমাদের কী প্রোগ্রাম–
আগে থেকেই সব ঠিক কবে রেখেছিল রণিতা আর অমিতেশ। রণিতা বলে, আপনার সম্বন্ধে অনেক ইনফরমেশন আমরা জোগাড় করেছি। সেগুলো কতটা সত্যি আর কতটা রটনা ভেরিফাই করে নিতে চাই। তা ছাড়া ইস্ট বেঙ্গলে আপনার অনেকগুলো বছর কেটেছে। সে সম্পর্কে আমরা তেমন কিছুই জানি না। আপনার ঐ লাইফটাও আমাদের জানা দরকার।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন নয়নতারা। তারপর বলেন, বেশ, ইস্ট বেঙ্গলের ব্যাপারটাই আগে শোন। তোমাদের সঙ্গে টেপ রেকর্ডার আছে তো?
আছে।
ওটা চালিয়ে দাও।
অমিতেশ তার ব্যাগ থেকে টেপ রেকর্ডার বার করে সুইচ টিপে সেন্টার টেবলে রাখে। নয়নতারা বলতে শুরু করেন।
নয়নতারা জন্মের পর প্রথম একুশটা বছর কাটিয়েছেন পূর্ব বাংলায়। সেই জীবনটা আদৌ চমকপ্রদ নয়, খুবই সাদামাঠা, নিস্তরঙ্গ। তাঁর বাবা ছিলেন হাই স্কুলে জিওগ্রাফির টিচার। পুরনো জমানার মাস্টারমশাইরা যেমন ছিলেন তিনি
তেমনি আদর্শবাদী, পা থেকে মাথা পর্যন্ত সৎ এবং বেশ রক্ষণশীলও। নয়নতারা, তখনকার লক্ষ্মী বা মমতা, মা-বাবার একমাত্র সন্তান। খুব একটা সচ্ছলতা ছিল না, তবু বেশ আদরেই মানুষ হয়েছেন। ঢাকার কলেজ থেকে বি.এ পাস করেছিলেন। যে পরিবারে তাঁর বিয়ে হয়েছিল সেখানে সবাই অল্পবিস্তর শিক্ষিত। তাঁর স্বামী এবং এক দেওর গ্র্যাজুয়েট, স্বামীর অন্য ভাইয়েরা কেউ ইন্টারমিডিয়েট পাস করেছিল, কেউ সে আমলের ম্যাট্রিকুলেট। তবে ওরা কেউ চাকরি বাকরি করত না। মাঝারি ধরনের পৈতৃক ব্যবসা ছিল ঢাকায়, সবাই সেটা চালাত। অবস্থা মোটামুটি ভালই বলা যায়।
শ্বশুরবাড়ির লোকেরা দু-একটা পাশ টাশ করলেও, লেখাপড়ার খুব একটা চর্চা ওখানে ছিল না। ইউনিভার্সিটির সার্টিফিকেট বা ডিগ্রি টিগ্রি ওরা জোগাড় করেছিল কিছুটা ওজন আর ইমপটান্স বাড়বার জন্য। নইলে ওগুলোর বিশেষ প্রয়োজন ছিল না।
ছোটখাট ব্যবসায়ীদের বাড়ির অখ্যাত গৃহবধূ হয়েই জীবন কেটে যেত সে আমলের মমতা বা লক্ষ্মীর। কিন্তু হঠাৎ দাঙ্গা এবং দেশভাগ হয়ে গেল। দাঙ্গায় তাঁর মা আর বাবা মারা যান। আর দেশভাগের কারণে ভাসতে ভাসতে তাঁরা কলকাতায় চলে আসেন শরণার্থী হিসেবে।