জিজ্ঞাসু সুরে রণিতা জিজ্ঞেস করে, কী সেটা?
স্টোরি রাইটার ক্যারেক্টার তৈরি করত–কোনো ছবিতে তার নাম শ্যামলী, কোনো ছবিতে বিশাখা, কোনোটায় সুপর্ণা বা মীনাক্ষী। ছবিতে নেমে আমি কখনও শ্যামলী, কখনও বিশাখা ইত্যাদি হয়ে গেলাম। ডায়ালগ রাইটাররা সংলাপ লিখে দিল, আমি গড়গড় সেগুলো আউড়ে গেলাম। ডিরেক্টর যেভাবে হাত-পা নাড়তে বলল, যেভাবে হাসতে বা লাফাতে ঝাঁপাতে বলল, হুবহু তাই করতে লাগলাম। স্বপ্নের সওদাগরেরা আমাকে স্ক্রিনের ড্রিম গার্ল বানিয়ে দিল। মিডিয়ার লোকেরা আমাকে নিয়ে হাজারটা মিথ তৈরি করে ফেলল। এমনকি আমার আসল নামটা পালটে নয়নতারা রাখা হল। ঠিক আছে, ধরা যাক, নামে না হয় কিছু আসে যায় না। কিন্তু–
রণিতারা কিছু বলে না, শুধু উন্মুখ তাকিয়ে থাকে।
নয়নতারা থামেন নি, আমর মনে হল, চিরকাল সুপণা, বিশাখা, শ্যামলী হয়েই কাটিয়ে দেব? মিডিয়া আমার যে ইমেজ তৈরি করে দিয়েছে তার বাইরে কোনোদিন বেরিয়ে আসতে পারব না? অন্যের হুকুমে নেচে গেয়ে আর ডায়ালগ বলেই জীবনটা শেষ হয়ে যাবে? নিজের বুকে একটা আঙুল রেখে বলেন, আমার মধ্যে যে লক্ষ্মী বা মমতা রয়েছে তার কি কিছুই করণীয় নেই? তাই
একদিন সব ফেলে নির্বাসনে চলে গেলাম। কিন্তু–
কিন্তু কী?
মিডিয়ার তৈরি মিথ আর ইমেজ আমার পিছু ছাড়ল না। ওরা আমার গায়ে এমন একটা স্ট্যম্প মেরে দিয়েছে যে রাস্তায় বেরুনো অসম্ভব। আট বছর আমি গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডে নেই, তবু পুরনো ইমেজ আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। সত্যি বলছি আমি এর হাত থেকে মুক্তি চাই।
কিছুক্ষণ চুপচাপ।
তারপর রণিতা বলে, আপনি তো নিজের মতো কিছু করার জন্যে নাটক আর ফিল্ম ছেড়েছিলেন। এই আট বছর কী করলেন?
নয়নতারা বলেন, সেটা বলার মতো নয়। তবে অনেক কিছুই করার ইচ্ছা।
যেমন?
তোমরা তো এখন থেকে রেগুলার আসছ। চোখ কান খোলা রাখলে নিজেরাই জানতে পারবে।
রণিতা হঠাৎ জিজ্ঞেস করে, কসবায় যে জমিটা কিনতে যাচ্ছেন সেটা দিয়ে কী করতে চান? যদিও জমির মালিকের সঙ্গে সেদিন কথা বলে তারা জেনে এসেছে মহৎ উদ্দেশ্যেই ওটা কেনা হচ্ছে, তবু প্রশ্নটা করল সে।
নয়নতারা চমকে ওঠেন, তোমরা জানলে কী করে? পরক্ষণে হেসে ফেলেন, ও বুঝেছি। সেদিন একজনের সঙ্গে ফোনে জমিটা নিয়ে আলোচনা করছিলাম। তখন তোমরা কাছে বসে ছিলে। তা কসবা পর্যন্ত ও তোমরা পৌঁছে গেছ? কী বিচ্ছু ছেলেমেয়ে!
অমিতেশ নিঃশব্দে খেয়ে যাচ্ছিল। এবার সে বলে, আমাদের সময়ের একজন লিজেন্ডারি আর্টিস্টকে নিয়ে ছবি করতে যাচ্ছি। তাঁর জীবনের সব দিক জানতে না পারলে ছবিটায় অনেক ফাঁক থেকে যাবে যে। কসবার খবরটা পেয়েই তাই ছুটে যেতে হল।
নয়নতারার কপাল সামান্য কুঁচকে যায়। তবে তিনি যে এই গোয়েন্দাগিরির জন্য বিরক্ত হন নি সেটা তাঁর মুখ দেখে টেব পাওয়া গেল। হাল ছেড়ে দেবার মতো কপট একটা ভঙ্গি করে বলেন, তোমাদের নিয়ে আর পারা যায় না।
রণিতা জিজ্ঞেস করে, ঐ জমিটা নিয়ে দারুণ কিছু একটা করার পরিকল্পনা নিয়েছেন নিশ্চয়ই?
তার ইচ্ছা নয়নতারা নিজের মুখেই সব বলুন। কিন্তু তিনি মৃদু হেসে শুধু বলেন, ওয়েট অ্যান্ড সি।
আপনি বলেছিলেন, আমাদের দুজনকে কী একটা কাজে লাগাবেন—
এই তো সবে যাওয়া-আসা শুরু করলে। কদিন যাক না, নিশ্চয়ই লাগাব।
কিছুক্ষণ চুপচাপ খেয়ে যায় ওরা।
একসময় রণিতা বলে, একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছে করে।
নয়নতারা জিজ্ঞাসু চোখে তাকান।
রণিতা বলে, আপনি তো এত বড় একজন শিল্পী। আপনার কি আর অভিনয় করতে একেবারেই ইচ্ছে নেই?
অনেকক্ষণ উত্তর দেন না নয়নতারা। তারপর ধীরে ধীরে বলেন, নিশ্চয়ই করে। একবার যে ক্যামেরা আর ফুটলাইটের সামনে দাঁড়িয়েছে তার পক্ষে অভিনয় ছেড়ে দেওয়াটা যে কত কষ্টকর, একজন অ্যাক্টর বা অ্যাক্ট্রেস না হলে সেটা বোঝানো যাবে না। তবে মিনিংফুল, পারপাসফুল ছবি ছাড়া আমি কিছু করব না। আমি চাই না কেউ আমাকে টাকা তৈরির মেশিন হিসেবে ব্যবহার করুক।
ধরুন তেমন ছবির অফার নিয়ে কেউ যদি আপনার কাছে আসে?
তোমার ভীষণ উৎসাহ দেখছি। তোমার হাতে তেমন কেউ আছে নাকি?
রণিতা বলে, না। তবে খবরের কাগজে যদি লিখি, আপনি আপনার শর্ত অনুযায়ী ফিল্ম ওয়ার্ল্ডে ফিরতে চান, বহু প্রোডিউসার ডিরেক্টর এ বাড়ির সামনে লাইন লাগিয়ে দেবে।
নয়নতারা আঁতকে ওঠেন, না, একেবারেই না। তোমাদের সঙ্গে জেন্টলম্যানস এগ্রিমেন্ট হয়েছে, আমাকে না জানিয়ে আমার কোনো খবর বাইরে জানাবে না, সেটা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে। তা ছাড়া এ ব্যাপারে আমি এখনও মনস্থির করে উঠতে পারিনি। যদি কখনও করি প্রোডিউসারদের দরকার নেই। নিজেই সব ব্যবস্থা করব।
খাওয়া শেষ হলে নয়নতারা বলেন, আমাকে এখন তিন ঘণ্টা ছুটি দিতে হবে কিন্তু। ঠিক চারটের সময় আবার তোমাদের সঙ্গে দেখা হচ্ছে।
রণিতা জিজ্ঞেস করে, দুপুরে কি আপনার ঘুমনোর অভ্যাস আছে? একেবারেই না।
তা হলে?
নয়নতারার মুখে লাজুক একটু হাসি ফোটে। বলেন, এই সময়টা একটু আধটু বইটই পড়ি, আর–
রণিতা বলে, আর কী?
সামান্য লেখালিখির চেষ্টা করি।
দারুণ উৎসাহিত হয়ে ওঠে রণিতা, কী লেখেন আপনি? ডায়েরি?
নয়নতারা বলেন, তেমন কিছু নয়।