রণিতারা লক্ষ করল, নয়নতারার সারা মুখে আশ্চর্য প্রশান্তি। তাঁর দুই চোখ অপার্থিব কোমল আলোয় ভরে গেছে।
অনেকক্ষণ কেউ আর কিছু বলে না।
এদিকে রণিতাদের চা খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। একসময় নয়নতারা বলেন, চল এবার খেয়ে নেওয়া যাক।
এ বাড়ির একতলা এবং দোতলা, দুজায়গাতেই ডাইনিং হল রয়েছে। নয়নতারা রণিতাদের সঙ্গে করে একতলায় চলে আসেন।
খাবার ঘরের পাশেই কিচেন। সেখানে বয়স্ক রান্নার লোক ছাড়া সন্ধ্যা এবং আরেকটি কম বয়সের মেয়ে যার নাম মালতী, অপেক্ষা করছিল।
নয়নতারা বলেন, বসো।
বড় রেক্ট্যাঙ্গুলার টেবিলের একদিকে বসেন নয়নতারা, তাঁর মুখোমুখি রণিতা আর অমিতেশ।
সন্ধ্যারা প্রস্তুত হয়েই ছিল। রণিতারা বসার সঙ্গে সঙ্গে ছোট ছোট টেবল ম্যাট, চামচ, ফর্ক, ন্যাপকিন ইত্যাদি সাজিয়ে খাবার দিতে শুরু করল। প্রথমে এল ভেজিটেবল সুপ। তারপর রণিতা এবং অমিতেশের জন্য ধবধবে সরু চালের ভাত, ঘি, নারকেল দিয়ে মুগের ডাল, আলু ও বড়ি ভাজা, কপির ডালনা, রুই মাছের কালিয়া, টমাটোর চাটনি এবং ঘরে পাতা ঘন দুধের দই। নয়নতারা ভাত খান না, তাঁর জন্য এল সাদা গমের ছোট ছোট তিনখানা রুটি, সুপ, এক প্লেট সবজি সেদ্ধ, দু টুকরো মাছ, এক বাটি ডাল আর টক দই।
খেতে খেতে হঠাৎ রণিতার চোখে পড়ে, কিচেনের দেওয়ালে নয়নতারার তিনটি ফিল্মের তিনটে স্টিল ফটো এনলার্জ করে টাঙানো রয়েছে। অবাক হয়ে সে জিজ্ঞেস করে, একটা কথা বলব?
নয়নতারা বলেন, নিশ্চয়ই।
গোটা বাড়িতে আপনার কোনো ছবি নেই। দেড়শরও বেশি ফিল্ম আর নাটকে অভিনয় করেছেন। তার বেশির ভাগই সুপার ডুপার হিট। কিন্তু সে সব বাদ দিয়ে বক্স অফিসে মোটামুটি সাকসেস হয়েছে এমন তিনটে ছবির স্টিল টাঙিয়ে রেখেছেন, তাও কিনা কিচেনের ওয়ালে!
নয়নতারা উত্তর দেন না, সামান্য হাসেন।
রণিতা বলে, আমার খুব আশ্চর্য লাগছে, আপনার এত পপুলার ছবি থাকতে শুধু এই তিনটে ফিল্মের স্টিল কেন?
নয়নতারা স্থির চোখে রণিতার দিকে তাকিয়ে বলেন, তুমি তো বুদ্ধিমতী মেয়ে, তুমিই বল না–
এবার খুব ভাল করে স্টিলগুলো লক্ষ করতে থাকে রণিতা। জনপ্রিয় ছবি বা নাটককে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে মাঝারি ধরনের সফল তিনটি ছবির স্টিল সযত্নে টাঙিয়ে রাখার মধ্যে কী মনোভাব কাজ করতে পারে?
স্টিল তিনটি যে ছবিগুলোর তা হল নিবেদিতা, ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈ এবং রানী রাসমণি। তিন মহীয়সী মহিলার জীবনী নিয়ে ফিল্মগুলো বিশ-পঁচিশ বছর আগে তৈরি হয়েছিল। বিদ্যুৎচমকের মতো রণিতার মনে হল, জাতির জীবনে যে তিন অসামান্যা নারী: বিরাট ভূমিকা পালন করে গেছেন, তাঁদের চরিত্রে অভিনয় করে নয়নতারা সবচেয়ে তৃপ্ত। ছবি তিনটি রণিতা দেখেছে, তার মনে হয়েছিল প্রাণ ঢেলে চরিত্রগুলি তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন। তার মানে, অনবরত রোমন্টিক ছবির নায়িকা হয়ে যে গণ্ডা গণ্ডা ছবিতে তিনি অলীক স্বপ্ন বিকিরণ করে গেছেন সেগুলো সম্বন্ধে তাঁর বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। নেহাত পয়সার জন্য নানা মালমশলা দিয়ে তৈরি এই ছবিগুলো তিনি করে গেছেন। যে ছবিতে সামাজিক তাৎপর্য বা দেশকাল সম্পর্কে ভাবনা-চিন্তা না থাকে সে ছবি তার কাছে মূল্যহীন।
রণিতা স্টিলগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে বলে, একটু বোধ হয় বুঝতে পেরেছি।
হাসিমুখে, বুঝিবা একটু মজার সুরেই নয়নতারা বলেন, শুনি, কী বুঝেছ–
স্টিল তিনটে দেখতে দেখতে খানিক আগে রণিতার যা মনে হয়েছিল, আস্তে আস্তে বলে যায় রণিতা।
শুনতে শুনতে উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠেন নয়নতারা। তাঁর কণ্ঠস্বর থেকে কিছুক্ষণ আগের মজার ভাবটা দ্রুত মুছে যায়। বেশ জোর দিয়েই বলেন, দ্যাটস লাইক আ ভেরি ভেরি ইনটেলিজেন্ট গার্ল। তুমি ঠিকই ধরেছ, যে ছবি বা নাটকে সোসাল অ্যাসপেক্ট নেই বা দেশ আর মানুষ সম্পর্কে যার মধ্যে কোনোরকম কমিটমেন্ট নেই তা আমার ভাল লাগে না। নায়কের বুকে মুখ বা মাথা রেখে, কী তাকে মুহুর্মুহু জড়িয়ে ধরে, তার গালে নাক ঘষে দিনের পর দিন পদায় সফট পননা তৈরি করে কিছু পয়সা পাওয়া যায় ঠিকই কিন্তু অ্যাজ অ্যান আর্টিস্ট, আ রিয়াল হিউম্যান বিয়িং, এটাই কি জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য?
নয়নতারাকে যেন এবার অল্প অল্প বোঝা যাচ্ছিল, সেই সঙ্গে তাঁর স্বেচ্ছা নির্বাসনের কারণটাও। রণিতা জিজ্ঞেস করে এই জন্যেই কি সব ছেড়ে একদিন অজ্ঞাতবাসে চলে গিয়েছিলেন?
আজ খুব একটা ভাল মুডে আছেন নয়নতারা। যে কথা আট বছর ধরে কখনও প্রকাশ করেন নি, ঘুণাক্ষরেও কেউ জানতে পারে নি তাঁর আকস্মিক গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ড ত্যাগের কারণ, দুটি ঝকমকে, শ্রদ্ধাশীল তরুণ-তরুণীকে সামনে পেয়ে তা বলার জন্য তিনি উন্মুখ হয়ে উঠেছেন।
নয়নতারা বলেন, তা বলতে পার। তবে অন্য কিছু কারণও আছে। সে সম্বন্ধে পরে আলোচনা করা যাবে। একটু থেমে ফের বলেন, আসল ব্যাপারটা কী জানো, ঐ সব কমার্শিয়াল ছবিতে কাজ করতে করতে আমি টায়ার্ড হয়ে পড়েছিলাম। প্রতিটি ছবিতে প্রায় এক ধরনের ক্যারেক্টার, একই রকম ডায়লগ, একই টাইপের সিচুয়েশন। বাচ্চারা শ্লেটের ওপর যেমন দিনের পর দিন দাগা বুলিয়ে যায়, অনেকটা সেই রকম। কিংবা বলতে পার একটা ছবি আরেকটার প্রায় জেরক্স কপি। এসব তো ছিলই, সেই সঙ্গে একটা প্রশ্ন বার বার আমাকে খোঁচা দিয়ে যাচ্ছিল।