একটা ব্যাপার লক্ষ করল রণিতা, এত বড় বাড়িতে নিজের একটি ছবিও নেই। এমনকি যে শ দেড়েক ফিল্ম আর নাটকে তিনি নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন তার একটি স্টিলও দেখা গেল না।
অমিতেশও তা লক্ষ করেছিল। সে বলে, কী ব্যাপার বল তো, নয়নতারার কোনো ছবি চোখে পড়ল না! নিজের সম্বন্ধে এত উদাসীনতা কেন ভদ্র মহিলার?
রণিতা বলে, কী জানি অন্য স্টাররা শুনেছি তাদের সারা বাড়ি নিজের ছবি দিয়ে বোঝাই করে রাখে। সেদিক থেকে নয়নতারা একটি মিস্টিরিয়াস ক্যারেক্টার।
দোতলা থেকে খানিক বাদে ওরা ছাদে চলে আসে। এখানে যেদিকেই তাকানো যাক, পলিথিনের পুরু শিটের ওপর দেড় ফুট মাটি বসিয়ে তার ওপর দারুণ একখানা রুফ গার্ডেন বানানো হয়েছে। মাঝখানে সবুজ কার্পেটের মতো খানিকটা ঘাসের জমিকে ঘিরে ছোট বড় অসংখ্য টবে পাতাবাহার, ঝাউ থেকে শুরু করে নানা ধরনের ফুল আর ফলের গাছ। একটা প্রকাণ্ড টবে অজস্র পাতিলেবু ফলে আছে, আরেকটায় গোল গোল পেয়ারা।
নয়নতারা যে গাছপালা ভালবাসেন সেটা এ বাড়িতে পা দিলেই টের পাওয়া যায়। সামনের দিকের খোলা বাগানে, একতলার সারি সারি পেতলের টবে আর এই রুফ গার্ডেনে শুধু গাছ আর গাছ।
মুগ্ধ চোখে রুফ গার্ডেনটা দেখছিল রণিতারা। হঠাৎ স্তোত্রপাঠের মতো কিছু কানে আসতে এধারে ওধারে তাকাতে থাকে। ছাদের পুব দিকের শেষ মাথায় একটা বেশ বড় ঘর চোখে পড়ে তাদের, সেখান থেকে কণ্ঠস্বরটা ভেসে আসছে।
রণিতা আর অমিতেশ পরস্পরের দিকে একবার তাকায়। তারপর নিঃশব্দে ঘরটার কাছে চলে আসে।
দরজা বন্ধ রয়েছে, তবে ডানপাশের জানালাটা খোলা। পায়ে পায়ে সেখানে গিয়ে দাঁড়ায় রণিতারা। উঁকি দিতে চোখে পড়ে একটা উঁচু বেদির ওর পশমের পুরু আসনের ওপর পা মুড়ে বসে আছেন নয়নতারা। চোখ দুটি বোজা, মেরুদণ্ড টান টান, হাত দুটি হাঁটুর ওপর ন্যস্ত। একেবারে ধ্যানস্থ চেহারা। সামনে কোনো দেবদেবীর মূর্তি নেই।
তন্ময় হয়ে নয়নতারা কিছু আবৃত্তি করে যাচ্ছিলেন, হয়তো কোনো ধর্মগ্রন্থের শ্লোক। তাঁর কণ্ঠস্বর আশ্চর্য সুরেলা, শোনাচ্ছিল অনেকটা গানের মতো। এই মুহূর্তে নয়নতারাকে ভারি পবিত্র মনে হচ্ছিল। ভারতীয় সিনেমার গ্ল্যামার কুইনকে এমন এক চেহারায় দেখা যাবে, কে ভাবতে পেরেছিল। মুগ্ধ চোখে পলকহীন তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে রণিতা।
অমিতেশ পাশ থেকে নিচু গলায় বলে, ভদ্রমহিলা যে এমন রিলিজিয়াস মাইন্ডেড সেটা এ বাড়িতে না এলে জানাই যেত না।
রণিতা অস্পষ্টভাবে কী উত্তর দেয়, বোঝা যায় না।
খানিকক্ষণ পরে দুজনে দোতলার হল-ঘরে নেমে এসে সোফায় বসে পড়ে।
অমিতেশ বলে, এখন এক কাপ চা পেলে খুব ভাল হত।
রণিতা বলে, নয়নতারা তো বলেই দিয়েছেন, আমাদের যা দরকার । কাজের লোকেদের জানালেই পেয়ে যাবে।
আশে পাশে কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। নিচে গিয়ে–
অমিতেশের কথা শেষ হবার আগেই ডান ধারের ঘরটা থেকে একটি মাঝবয়সী লোক হল-ঘরে এসে ঢোকে। একে আগেও দেখেছে অমিতেশা, নাম হারাধন। ভ্যাকুয়াম ক্লিনার দিয়ে রোজ সারা বাড়ির ধুলোবালি পরিষ্কার করা খুব সম্ভব তার আসল কাজ। অন্তত দেখে শুনে সেটাই মনে হয়েছে অমিতেশদের।
রণিতা বলে, আমাদের একটু চা খাওয়াতে পার হারাধনদা?
হারাধন সসম্ভ্রমে বলে, আমি এক্ষুনি সন্ধ্যাদিদিকে গিয়ে বলছি। বলে শশব্যস্তে চলে যায়।
কিছুক্ষণ পরে সেই মহিলাটি ট্রেতে টি-পট, সুগার কিউব, মিল্কপট এবং বোন চায়নার কাপ টাপ সাজিয়ে এনে রণিতাদের সামনে সেন্টার টেবিলে রাখে। বাড়িতে প্রথম যেদিন রণিতা আসে, তার জন্য এই মহিলাই ট্রলিতে করে ব্রেকফাস্ট . নিয়ে এসেছিল। এর নাম যে সন্ধ্যা সেটা অবশ্য জানা ছিল না।
সন্ধ্যা দাঁড়ায় না, ট্রে নামিয়ে রেখে চলে যায়। হয়তো ভেতরে তার কোনো জরুরি কাজ আছে।
ধীরেসুস্থে চা তৈরি করে একটা কাপ অমিতেশকে দিয়ে নিজে এক কাপ নেয় রণিতা। সবে ওরা চায়ে চুমুক দিয়েছে, নয়নতারা হল-ঘরে চলে আসেন। খুব সম্ভব সোজা ছাদ থেকেই আসছেন তিনি। ওঁকে দেখে উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিল রণিতারা, নয়নতারা বলেন, বস, বস। নিজেও ওদের পাশে বসতে বসতে বলেন, এত বেলায় চা খাচ্ছ। লাঞ্চের সময় কিন্তু হয়ে গেছে।
অমিতেশ বলে, চাটা আমরা একটু বেশিই খাই। আমাদের কাছে এনি টাইম ইজ টি টাইম।
নয়নতারা এ নিয়ে আর কিছু বলেন না।
একটু চুপচাপ।
তারপর রণিতা বলে, আজ একজন বিখ্যাত মানুষকে আমরা নতুন করে আবষ্কার করেছি। সাজানো গোছানো বইয়ের ভাষাতেই কথাগুলো বলল সে।
নয়নতারা কিছু একটা অনুমান করে উৎসুক সুরে জিজ্ঞেস করেন, কাকে আবিষ্কার করলে?
রণিতা বলে, আপনাকে। ধর্মের ব্যাপারে আপনার যে এতটা নিষ্ঠা, আগে আমাদের ধারণা ছিল না।
নয়নতারা চোখ সরু করে সকৌতুকে রণিতাকে লক্ষ করতে করতে বলেন, বুঝেছি। তোমরা নিশ্চয়ই ছাদে গিয়েছিলে?
হ্যাঁ। আস্তে মাথা নাড়ে রণিতা।
আসলে ধর্ম কিনা জানি না, আমার ঠাকুরদা ছেলেবেলায় গীতা, চণ্ডী, ব্যাসদেবের মহাভারত আর বেদ-উপনিষদের অসংখ্য শ্লোক আমাকে মুখস্থ করিয়েছিলেন। তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন বোজ সকালে একঘণ্টা করে শ্লোকপাঠ করতে হত। তিনি মারা যাবার পরও অভ্যাসটা গেল না। ওটা কেমন যেন নেশার মতো হয়ে দাঁড়াল। পরে আমার বিয়ে হল, তারপর দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে কলকাতায় চলে এলাম। বেঁচে থাকার জন্যে অভিনয় শুরু করলাম। তিরিশ বত্রিশটা বছর সিনেমা আর স্টেজে কী প্রচণ্ড ব্যস্ততার ভেতরেই না কেটে গেল কিন্তু তার মধ্যেও সময় করে শ্লোকপাঠটা চালিয়ে যেতে লাগলাম। আর এখন তো রিটায়ার্ড লাইফ। হাতে অনন্ত সময়। আগে এক ঘণ্টা শ্লোকপাঠ করতাম, আজকাল সেটা বাড়িয়ে করেছি দুঘণ্টা। একটানা বলতে বলতে একটু থামেন নয়নতারা। তারপর ধীরে ধীরে ফের শুরু করেন, এর সঙ্গে ধর্মের যোগ কতটা, বলতে পারব না। তবে আমার খুব ভাল লাগে। কী যে আনন্দ পাই, বোঝানো যাবে না। কিছুক্ষণের জন্য হলেও মনটা সবরকম গ্লানি থেকে মুক্ত হয়ে যায়। এই সময়টা আমার মনে হয়, বিরাট কিছু পেয়ে গেলাম।