ওদের কথাবার্তার মধ্যে কটা ফোন আসে। সবাইকেই ওপার বাংলার ডায়লেক্টে সেই সেদিনের মতো নয়নতারা জানিয়ে দেন, মেমসাব বাড়িতে নাই। কহন তেনারে পাইবেন, কইতে পারুম না। নমস্কার–পন্নাম আইচ্ছা রাখি।
ফোনের কথোপকথন শেষ হলে নয়নতারা রণিতাকে বলেন, তোমাদের যে এই বাড়িতে ঢুকে ডকু-ফিচারটা করতে দিচ্ছি তাতে আমার কিছু স্বার্থ আছে। আমার একটা কাজ হয়তো তোমাদের করে দিতে হবে।
রণিতা উৎসুক সুরে জিজ্ঞেস করে, কী স্বার্থ? কী কাজ?
এক্ষুনি সেটা বলছি না। নয়নতারা বলেন, কিছুদিন তোমাদের দেখি, তারপর বলব।
হালকা গলায় রণিতা বলে, আমাদের যাচাই করে নিতে চান?
যা বলেছ। নয়নতারাও হাসেন।
.
১৮.
পরদিন বেশ সকালেই অমিতেশ আর রণিতা টেপ রেকর্ডার, নোট বুক পেন, নানা রঙের টিউব, তুলি, একটা স্টিল ক্যামেরা ব্যাগে পুরে চলে আসে রণিতার আঁকার হাত চমৎকার, যদিও আর্ট স্কুলে কোর্স করে ডিগ্রি বা ডিপ্লোম নেয় নি। তাকে মোটামুটি স্বয়ংশিক্ষিত বলা যায়, নিজের চেষ্টাতেই যা শেখার সে শিখেছে।
চিত্রনাট্য লেখার ব্যাপারে সত্যজিৎ রায় তার মডেল। তাঁর মতোই নানা দৃশ্যের ছোট ছোট স্কেচ সে আগেই এঁকে নেয়। নয়নতারাকে নিয়ে যে ডকু ফিচারটার পরিকল্পনা রণিতা করেছে তার স্ক্রিন-প্লে লেখার সময় এখনও আসে নি, তবু তাঁর নানা মুডের বেশ কিছু ছবি এঁকে রাখবেরণিতা, পরে এগুলোকে চলমান দৃশ্যমালার ফাঁকে ফাঁকে ব্যবহার করবে। রঙিন এই স্কেচগুলো ডকু ফিচারটির আকর্ষণ অনেক বাড়িয়ে দেবে।
এখানে আপাতত তাদের একমাত্র কাজ হবে নয়নতারাকে সারাদিন অনুসরণ করে যাওয়া, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্ত তিনি কিভাবে কাটান তা লক্ষ করা। মাঝে মাঝে তাঁর সঙ্গে কথা বলে নানা তথ্য জেনে নেওয়া এবং যে সব উপকরণ এতদিন ধরে জোগাড় করেছে সেগুলো কতটা সত্যি আর কতটা রটনা তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করা।
আটটার আগেই এ বাড়িতে পৌঁছে গিয়েছিল রণিতারা। এর মধ্যে স্নান শেষ নয়নতারার। হালকা গোলাপি রঙের মিহি টাঙ্গাইল শাড়ি আর ঐ রঙেরই ব্লাউজ তাঁর পরনে। শ্যাম্পু-করা ফাঁপানো চুল পিঠময় ছড়ানো, চোখে সরু করে কাজলের টান, কপালে ম্যাজেন্টা রঙের গোল টিপ।
দোতলার বড় হল-ঘরে রণিতাদের বসিয়ে নয়নতারা বলেন, কাজ শুরুর আগে ব্রেকফাস্টটা করে নাও।
রণিতা বিব্রতভাবে বলে, আমরা খেয়ে এসেছি।
নয়নতারার চোখমুখ দেখে মনে হল, বেশ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। বললেন, কাল থেকে খেয়ে এলে কিন্তু চলবে না। সকালে ব্রেকফাস্ট, দুপুরে লাঞ্চ, বিকেলে স্ন্যাকস–সব এখানে, বুঝলে?
রণিতারা ঠিক করে রেখেছিল ব্রেকফাস্ট সেরে সকালে তারা এখানে আসবে, দুপুরে এক ফাঁকে বেরিয়ে কোথাও গিয়ে লাঞ্চটা খেয়ে আসবে। বিকেলে বিশেষ খাওয়া টাওয়ার অভ্যাস নেই তাদের। এ বাড়িতে তখন একটু চা পাওয়া গেলে ভাল, না পেলেও অসুবিধা নেই। সব রকম পরিস্থিতিতেই তারা অভ্যস্ত। মধ্যপ্রদেশের দুর্গম অঞ্চলে কিংবা আসামের মিকির পাহাড়ে ডকুমেন্টারি ছবি তুলতে গিয়ে বহুদিন তাদের খাওয়া জোটেনি। এসব নিয়ে তারা বিশেষ মাথা ঘামায় না। রণিতাদের কাছে কাজটাই আসল।
আতিথেয়তার ব্যাপারে বিন্দুবাসিনীর সঙ্গে নয়নতারার দারুণ মিল। খাওয়া নিয়ে আপত্তি করলে যদি এ বাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে যায় সেই ভয়ে রণিতা বলে, ঠিক আছে, আপনি যা বলবেন তাই হবে।
নয়নতারা খুশি হন, গুড। একটু থেমে আবার বলেন, তোমাদের আসতে কিন্তু বেশ দেরি হয়ে গেছে। আমার দিন শুরু হয় ভোর সাড়ে পাঁচটায়। তখন একজন ইনস্ট্রাক্টর এসে আমাকে চল্লিশ মিনিট নানা রকম যোগাসন করিয়ে দিয়ে যায়। সেটা কিন্তু তোমাদের দেখা হল না।
আরেক দিন দেখে নেব।
অত ভোরে কি এখানে পোঁছুতে পারবে? দেখতে হলে আগের দিন রাত্তিরে এ বাড়িতে থেকে যেতে হয়।
আপনি অনুমতি দিলে থাকব।
ঠিক আছে, যেদিন ইচ্ছে থেকো।
একটা মুভি ক্যামেরা নিয়ে আসব কিন্তু।
আসনের ছবিগুলো তুলে রাখবে তো?
হ্যাঁ।
রেখো।
একটু চুপচাপ।
তারপর হঠাৎ হল-ঘরের ওয়াল ক্লকটার দিকে চোখ যেতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন নয়নতারা, আমাকে এবার উঠতে হবে। মেটিরিয়ালের খোঁজে তোমরা এ বাড়ির যেখানে ইচ্ছে যেতে পার। কাজের লোকেদের বলা আছে, কেউ বাধা দেবে না। চা খেতে ইচ্ছে হলে ওদের বলল, দিয়ে যাবে। বলতে বলতে উঠে পড়েন তিনি।
রণিতা জিজ্ঞেস করে, আবার কখন দেখা হবে আপনার সঙ্গে?
দুঘণ্টা পর।
আপনি কি বাইরে কোথাও যাবেন?
না, বাড়িতেই থাকব।
রণিতাদের আর কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে নয়নতারা বাঁ দিকের একটা ঘরের ভেতর অদৃশ্য হয়ে যান।
তারপরও বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকে রণিতা আর অমিতেশ। নয়নতারা ওভাবে চলে যাওয়ায় তারা বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিল।
একসময় অমিতেশ জিজ্ঞেস করে, হঠাৎ উনি চলে গেলেন কেন?
রণিতা বলে, কী করে বলব? হয়তো কোনো জরুরি কাজ আছে। একটু ভেবে বলে, বসে থেকে লাভ নেই। চল, বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখা যাক। কোন কোন স্পট থেক শুটিং করব সেগুলো ঠিক করে রাখি।
সেই ভাল।
এ বাড়ির যেখানে খুশি যাবার জন্য ঢালাও অনুমতি দিয়েছেন নয়নতারা। রণিতারা দোতলার ঘরগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে। এখানে পাঁচটা বেড-রুম। সবগুলোই চমৎকার সাজানো গোছানো। হল-এর মতো শোবার ঘরের দেওয়ালেও নামকরা শিল্পীদের অসংখ্য চোখ-জুড়নো পেইন্টিং।