নয়নতারা তার মনোভাব বুঝতে পারছিলেন। বলেন, আরম্ভ তো কর, তারপর দেখা যাক।
পুরো টাকাটা নয়নতারা জোগাড় করে দিতে পারবেন কিনা, রণিতার কাছে তা পরিষ্কার হয় না। কিন্তু এ নিয়ে প্রশ্ন করলে যদি বিরক্ত হয়ে গোটা প্রোপোজালটা নাকচ করে দেন তাহলে তো আর আশাই নেই। বণিতা বলে, আপনি যা বলবেন, তাই হবে।
আরেকটা কথা–
বলুন।
ছবিটা হয়ে যাবার পর আমাকে না জানিয়ে কাউকে দেখাতে পারবে না। রাজি?
রাজি।
তা হলে নেক্সট উইক থেকে কাজ শুরু করতে পার।
নেক্সট উইকে পারব না।
কেন?
রণিতা জানায়, নয়নতারা সম্পর্কে তারা যেটুকু জেনেছে তার সবটাই কাগজপত্র পড়ে এবং ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি, থিয়েটার ওয়ার্ল্ডের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে। অবশ্য নয়নতারার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে দেখা করে তেমন কিছু জোগাড় করা যায় নি। কিন্তু সেসবের ওপর নির্ভর করে,একটা নিখুঁত বিশ্বাসযোগ্য জীবনচিত্র তৈরি করা যায় না। বিদ্বেষের কারণে অনেকে নয়নতারা সম্পর্কে কুৎসিত মন্তব্য করেছে, আবার প্রবল উচ্ছ্বাসে অন্ধ অনুরাগীরা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তাঁর অলৌকিক এক ইমেজ তৈরি করে চোখ কান ধাঁধিয়ে দিয়েছে। সেটা নয়নতারার জীবনের একটা বড় দিক নিঃসন্দেহে, কিন্তু এর বাইরেও তাঁর ব্যক্তিগত একটা জীবনও রয়েছে তা একান্তভাবেই তার নিজস্ব। সেখানে মিডিয়া এখনও পৌঁছুতে পারে নি।
গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডের মানুষ, বিশেষ করে চিত্রতারকারা দুধরনের হয়ে থাকে। হয় তারা দারুণ খোলামেলা, এদের গোপন বলতে কিছু নেই। আবার কেউ কেউ আছে যারা নিজের সম্বন্ধে খানিকটা জানিয়ে বেশির ভাগটাই রহস্যের মোড়কে ঢেকে রাখে। এরা হয়তো মনে করে এই গোপনতা তাদের সম্পর্কে লোকের কৌতূহল অনেক বাড়িয়ে দেবে। মিডিয়া এদের পেছনে উদভ্রান্তের মতো ছুটতে থাকে। নয়নতারা কিন্তু এই দুদলের কোনোটাতেই পড়েন না। স্টেজ বা স্ক্রিন কেরিয়ার নিয়ে তাঁর বিন্দুমাত্র মোহ নেই। মিডিয়াকে হাজার মাইল দূরে সরিয়ে একেবারে নিজের মতো করে জীবনযাপন করতে চান। কোনো গ্ল্যামার বা রহস্যসৃষ্টির জন্য নয়, সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত কারণে।
অন্য চিত্রতারকারা টাকা, নাম, গ্ল্যামার, এসব নিয়েই খুশি। কিন্তু তাদের থেকে আলাদা নয়নতারা, নইলে গ্ল্যামারের সেন্টার স্টেজে থাকতে থাকতে কেউ এভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়?
মিডিয়া যে মিথ তৈরি করে রেখেছে তার বাইরেও অন্য এক নয়নতারা আছেন যিনি গ্ল্যামারের মধ্যে জীবন কাটাতে চান না। স্টেজ এবং স্ক্রিনের বাইরে কোন ভূমিকা তিনি পালন করছেন সেটা এখনও জানা যায়নি। তবে এই দুই নয়নতারাকে মেলাতে পারলে তবেই তাব ডকু-ফিচারটা জীবন্ত হয়ে উঠবে।
এ সব জানিয়ে রণিতা নয়নতারাকে বলে, এর জন্য বেশ কিছুদিন কাছে কাছে থেকে আপনাকে অবজার্ভ করা দরকার।
চোখ কুঁচকে কয়েক পলক রণিতাকে লক্ষ করেন নয়নতারা। তারপর বলেন, সেটা কী করে সম্ভব? তুমি থাকো ও বালিগঞ্জে, আমি ওল্ড আলিপুরে। চার মাইল দূরে থেকে অবজার্ভ করবে কী করে?
আপনি একটু ভাবুন–
ভাবাভাবির কী আছে। কাছে থেকে অবজার্ভ করতে হলে তো তোমাদের এখানে এসে থাকতে হয়–
আমারও তাই মনে হয়।
নয়নতারা ঝাঁঝিয়ে উঠতে গিয়ে হেসে ফেলেন, তুমি অতি ধুরন্ধর ছুকরি, সাঙ্ঘাতিক ফন্দিবাজ। আমার মুখ দিয়ে নিজের মতলবের কথাটা ঠিক বার করে নিলে।
রণিতা হাসতে থাকে।
নয়নতারা জিজ্ঞেস করেন, কতদিন আমার বুকের ওপর চেপে বসে থাকতে চাও?
রণিতা বলে, যতদিন না আপনাকে পুরোপুরি জানতে পারছি। একটু চুপচাপ।
এবার রণিতা বলে, আমরা সকালে চলে আসব, সন্ধের পর ফিরে যাব। রাত্তিরে থাকব না।
নয়নতারা অবাক হবার ভান করেন, সে কী! তাঁর বিস্ময়ের কারণটা বুঝতে না পেরে রণিতা বিমূঢ়ের মতো তাকায়।
নয়নতারা ঝপ করে গলা নামিয়ে চাপা ফিসফিসানির মতো বলে, রাত্তিরে থাকলে কেলেঙ্কারি টেলেঙ্কারি করছি কিনা জানবে কী করে?
রণিতার মতো স্মার্ট ঝকঝকে মেয়েও কেমন যেন হকচকিয়ে যায়, কী উত্তর দেবে ভেবে পায় না।
নয়নতারা থামেন নি, এইসব কেলেঙ্কারি টেলেঙ্কারি যদি ভাল করে ইউজ করতে পার তোমার ডকু-ফিচারটা কিন্তু দুর্দান্ত জমে যাবে।
রণিতা বুঝতে পারছিল নয়নতারা মজা করছেন। সে সসম্ভ্রমে বলে, আপনি ওসব করেন, এ আমি বিশ্বাস করি না।
কৌতুকে নয়নতারার ভুরু অল্প অল্প নাচতে থাকে। তিনি বলেন, আমার বয়েস ষাট হয়েছে বলে? জানো না আমার নামে চারদিকে কত স্ক্যান্ডাল। আট বছর আগে ফিল্ম টিন্ম ছেড়ে চলে এসেছি, স্ক্যান্ডালটা কিন্তু আমার পিছু ছাড়ে নি, সুযোগ পেলে কেউ না কেউ এখনও আমার নামে কুৎসা রটিয়ে বেড়ায়।
যে যা খুশি করুক, স্ক্যান্ডাল নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই।
কিছুক্ষণ কেউ আর কিছু বলে না।
তারপর নয়নতারা শুরু করেন, বেশ, সকালে এসে সারাদিন থেকে চলে যেও। একজন নিবাপিত চিতারকা যে এখন আর কিছুই করে না, সব কিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে, তার কাছে থাকতে থাকতে বোর হয়ে যাবে।
হাসিমুখে রণিতা বলে, দেখা যাক।
কবে থেকে আমাকে পর্যবেক্ষণ করতে চাও?
আপনি যেদিন থেকে বলবেন।
নয়নতারা বলেন, জ্বালাতন যখন করবেই তখন আর দেরি করে কী হবে। কাল থেকেই শুরু করে দাও।
রণিতা বলে, থ্যাঙ্ক য়ু ম্যাডাম।