সেটাই জানতে হবে। মানুষের চরিত্রে কত রকমের অ্যাঙ্গল যে থাকে!
.
১৭.
নয়নতারার বাড়ি থেকে সেদিন চলে আসার পর দু সপ্তাহ কেটে গেছে
বর্ষা এবারের মত বিদায় নিয়েছে। ঝকঝকে নীলাকাশে পেঁজা তুলোর মতো ধবধবে হালকা কিছু মেঘ আজকাল ভেসে বেড়ায়। যত দিন যাচ্ছে শরতের রোদে তত বেশি করে সোনালি আভা ফুটে বেরুচ্ছে।
ইদানীং যতক্ষণ রণিতা বাড়িতে থাকে তার কান পড়ে থাকে টেলিফোনের দিকে। ইন্দ্রনাথের বিপুল উৎসাহ তাকে পুরোপুরি হতাশ হতে দেয় না। যদিও দুরাশা, তবু আবছাভাবে মনে হয়, হয়তো নয়নতারা শেষ পর্যন্ত মত পালটে তাবে ফোন করবেন।
এদিকে মায়ের সঙ্গে ঠাণ্ডা লড়াইটা এখনও শেষ হয়নি, তার বিয়ে ন। হওয়া পর্যন্ত হবেও না। তবে কিছুদিন হল সুধাময়ী মেয়ের সঙ্গে কথা বলছেন, যদিও মুখটা সবসময় থমথমে হয়ে থাকে।
বাড়ি থেকে বেরুবার সময় রোজই রণিতা সুধাময়ীকে বলে যায়, কেউ ফোন করলে যেন তার নামটা লিখে রাখেন। কিন্তু চোদ্দ দিন কেটে গেলেও নয়নতারার দিক থেকে কোনোরকম সাড়াশব্দ নেই।
যখন নয়নতারা পর্বটা মাথা থেকে পুরোপুরি বার করে দিয়ে অন্য কোনো সাবজেক্ট নিয়ে রণিতা ভাবতে শুরু করেছে সেই সময় একদিন সকালে নয়নতারার ফোন এল, আমি রণিতার সঙ্গে কথা বলতে চাই।
সেই সুরেলা, স্বপ্নগন্ধী কণ্ঠস্বর যা শ্রোতাদের মধ্যে বিদ্যুৎপ্রবাহ ঘটিয়ে দেয়। শিরদাঁড়া টান টান করে রণিতা বলে, আমিই রণিতা–
ভাল আছ তো?
হ্যাঁ, আপনি?
চমৎকার। কদিন ধরেই তোমার কথা ভাবছিলাম।
রণিতা উত্তর দেয় না, এরপর নয়নতারা কী বলেন তা শোনার জন্য উগ্রীব হয়ে থাকে।
নয়নতারা বলেন, তুমি কি আমাদের বাড়ি একবার আসতে পারবে?
রণিতা ভাবে, তিনি মত পালটেছেন কিনা জিজ্ঞেস করে কিন্তু পরক্ষণে মনে হয় ওঁর কাছে গেলেই তো সব জানা যাবে। ততক্ষণ ধৈর্য ধরে থাকা যাক। বলে, নিশ্চয়ই পারব। কবে যেতে বলছেন?
কোনো জরুরি কাজ না থাকলে এখনই চলে এস না—
ঠিক আছে। ঘণ্টাখানেকের ভেতর পৌঁছে যাচ্ছি।
আর ঐ ইয়ংম্যানটি যে সারাক্ষণ তোমার গায়ে আঠার মতো জুড়ে থাকে, তাকেও এনো।
রণিতা হাসে, আচ্ছা–
নয়নতারা ফোন ছেড়ে দিতেই রণিতা অমিতেশকে তাদের বাড়িতে ডায়াল করে ধরে ফেলে, তোমার কাছাকাছি ঘড়ি আছে?
অমিতেশ লেট-রাইজার, সাড়ে আটটার আগে কোনোদিন তার ঘুম ভাঙে না। জড়ানো গলায় বলে, আছে। কেন?
কণ্ঠস্বর শুনে মনে হল ঘুমের রেশ এখনও কাটে নি অমিতেশের। রণিতা বলে, কটা বাজে দেখ।
আটটা বেয়াল্লিশ।
আটাশ মিনিট সময় দিলাম। ঠিক নটা দশে মেট্রো রেলের কালিঘাট স্টেশনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে–
ইয়ার্কি নাকি! এখনও আমার মুখটুখ ধোওয়া হয়নি, শেভ করিনি, এত তাড়াতাড়ি–
কোনো কথা শুনতে চাই না। যা বললাম তাই করবে। শার্প অ্যাট টেন মিনিটস পাস্ট নাইন–
কিন্তু ব্যাপারটা কী?
দেখা হলে বলব। রণিতা লাইন কেটে দেয়।
.
নটা পঁচিশে রণিতা আর অমিতেশ চোদ্দ নম্বর রবিনসন স্ট্রিটের দোতলার হল-ঘরে যখন সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসে, নয়নতারা একটা সোফায় বসে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। বললেন, বসোরণিতারা বসলে বলেন, খুব অবাক হয়ে গেছ, না?
রণিতা বলে, তা একটু হয়েছি। ভাবতে পারি নি, আপনি ফোন করবেন।
.
বিশেষ দরকারে ফোনটা করতে হল। নয়নতারা বলেন, আগেই করতাম। ভেবে দেখলাম, কটা দিন তোমাদের ওপর নজর রাখি।
তাঁর কথার মধ্যে একটা ইঙ্গিত ছিল, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না রণিতার। বলে, আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করি কিনা, সেটা দেখতে চাইছিলেন?
হ্যাঁ। সেনসেসন ক্রিয়েট করতে তোমরা যে আমার কথা কাগজে বার করে দাও নি, সে জন্যে খুব খুশি হয়েছি।
একটু চুপচাপ।
তারপর নয়নতারা বলেন, তোমরা সেদিন চলে যাবার পর তোমাদের পোপোজালটা নিয়ে অনেক বার ভেবেছি।
রণিতারা উন্মুখ হয়ে ছিল। বলে, কী ভাবলেন?
নয়নতারা বলেন, আর্টিস্ট হিসেবে, বিশেষ করে একজন মানুষ হিসেবে আমার অনেক কিছু বলার আছে। সেই জন্যে তোমাদের প্রস্তাবে আমি রাজি।
সমস্ত শরীরে যেন শিহরন খেলে যায় রণিতার। গাঢ় আবেগের গলায় বলে, আপনাকে কী বলে কৃতজ্ঞতা জানাব বুঝতে পারছি না। আমার অনেক দিনের স্বপ্ন এবার সার্থক হবে।
নয়নতারা বলেন, আমার কথা কিন্তু শেষ হয় নি।
রণিতা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। তার মনে সংশয়ের একটু ছায়া পড়ে।
নয়নতারা বলেন, আমার কিছু শর্ত আছে।
রণিতা বলে, কী শর্ত?
ডকু-ফিচারটা করতে হবে গোপনে। কেউ জানুক সেটা আমি একেবারেই চাই না।
তা কী করে সম্ভব?
অসুবিধেটা কোথায়?
রণিতা বলে, দূরদর্শন এটা কমিশন করছে, তারা টাকা দেবে। ওদের তো জানাতেই হবে।
ওদের টাকা নিতে হবে না।
অবাক হয়ে রণিতা বলে, না নিলে ছবিটা করব কী করে? আমার কি টাকা আছে?
নয়নতারা বলেন, তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই, আস্তে আস্তে ছবিটা কর। শুরু করার জন্যে যাদরকার আমি তার ব্যবস্থা করব।ভিডিও করতে চাও,না ফিল্মে?
ফিল্ম করারই ইচ্ছে।
তা হলে ক্যামেরাম্যান, সাউন্ড রেকর্ডিস্টও চাই। তারা আবার বাইরে আমার কথা জানিয়ে দেবে না তো?
আমার টিমে যারা কাজ করে তারা খুবই ট্রাস্টওয়ার্দি, তারা এ নিয়ে কারো সঙ্গে আলোচনা করবে না। কিন্তু–
কী?
ডকু-ফিচারটা করতে অনেক টাকা লাগবে বলতে বলতে চুপ করে যায় রণিতা।