দ্বিধান্বিতভাবে রণিতা বলেছে, আচ্ছা, থাকিস।
.
সেদিন রণিতা ঠিক করেছিল কসবায় গিয়ে রজনী দত্ত রোডে সেই জমিটার, খোঁজ করবে। আজ বিকেলে অমিতেশকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে হানা দিল সে এবং দু-একজনকে জিজ্ঞেস করে জায়গাটা বারও করে ফেলল।
জমিটা চৌকো এবং বেশ উঁচু। তার একধারে ভাঙাচোরা খাপরার চালায় একটা চায়ের দোকান। বৃষকাঠের মতো চেহারা, মাঝবয়সী একটা লোক মান্ধাতার আমলের একটা ডেকচিতে চা ফোঁটাচ্ছিল। সামনের দুটো নড়বড়ে বেঞ্চে বসে কটি মজুর ক্লাসের লোক সতৃষ্ণ চোখে সেদিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছিল।
জানা সত্ত্বেও রণিতা দোকানদারকে জিজ্ঞেস করল, এটা কি আঠারো নম্বর রজনী দত্ত রোড?
লোকটার চোখের ডাঁটি ভাঙা নিকেলের গোল চশমা মাথার পেছন দিকে সুতো দিয়ে বাধা। চশমার ওপর দিয়ে সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে দোকানদার জিজ্ঞেস করে, কেন বলুন তো?
পালটা প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিল না রণিতা। একটু থমকে যায় সে, পরক্ষণে একটা বিশ্বাসযোগ্য জবাব মনে মনে বানিয়ে ফেলে। বলে, আমরা একটা ফ্ল্যাট কিনব। শুনেছি এই জামিতে একটা ফ্ল্যাট-বাড়ি তৈরি হবে। তাই–
লোকটা খোলা ছাড়ানো শুকনো নারকেলের মতো মাথাটা নাড়তে নাড়তে বলে, সে গুড়ে বালি মেমসাহেব–
মানে?
এ জমি কাকে যেন বিক্রি করে দিচ্ছে মালিক। ফ্ল্যাট বাড়িটাড়ি কিসসু হবে না। যে কিনছে নিজের থাকার জন্যে বাড়ি করবে।
জমিটার মালিক কে?
অবিনাশ তরফদার।
তিনি থাকেন কোথায়?
ডান পাশে তিনটে বাড়ির পর চার নম্বর বাড়িটা দেখিয়ে দেয় দোকানদার। সেখানে গিয়ে কলিং বেল টিপতেই কাজের লোক রণিতা আর অমিতেশকে সাদামাঠা একটা ড্রয়িং রুমে নিয়ে বসিয়ে ভেতরে খবর দিতে চলে যায়।
কিছুক্ষণ পর বাষট্টি তেষট্টি বছরের একজন বৃদ্ধ ঘরে এসে ঢোকেন। এই বয়সেও ভারি সুপুরুষ অবিনাশ তরফদার। অত্যন্ত শান্ত, ভদ্র, সৌম্য চেহারা। তাকে দেখলে শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছা হয়।
রণিতারা উঠে দাঁড়িয়েছিল। অবিনাশ বলেন, বসুন আপনারা। রণিতারা বসলে তিনিও মুখোমুখি একটা সোফায় বসেন, কোত্থেকে আসছেন?
রণিতা বলে, আমরা কলকাতাতেই থাকি।
আমার কাছে কিছু দরকার আছে?
হ্যাঁ। আঠারো নম্বর রজনী দত্ত রোডে আপনার যে জমিটা রয়েছে সে সম্পর্কে আমরা ইন্টারেস্টেড। কো-অপারেটিভ করে একটা ফ্ল্যাট-বাড়ি বানাতাম।
অবিনাশ বলেন, কিন্তু মা ওটা তো আর কাউকে দেওয়া যাবে না।
অমিতেশ জিজ্ঞেস করে, কেন বলুন তো?
পরশু জমিটা বায়না হয়ে গেছে।
বায়নার টাকাটা কি ফেরত দেওয়া যায় না?
তা কী করে সম্ভব! অবিনাশ হাসেন।
রণিতা বলে, যদি কিছু মনে না করেন একটা কথা জানতে চাইছি। যাঁরা বায়না করেছেন, তাঁরা কিরকম দাম দিচ্ছেন? অবশ্য যদি আপত্তি থাকে–
অবিনাশ বলেন, আপত্তির কিছু নেই। আমি কাঠায় চল্লিশ হাজার করে পাচ্ছি।
জমিজমার দাম সম্বন্ধে বিশেষ ধারণা নেই রণিতার। বিষয়-আশয় নিয়ে কোনোকালে সে মাথা ঘামায় নি। তবে এটুকু শুনেছে, এ অঞ্চলের জমি নাকি ইদানীং সোনার দরে বিকোচ্ছে। অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার মতো সে বলে, শুনেছি এখানকার জমি পার কাঠা এক লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
তার থেকেও বেশি–দেড় লাখ।
আমরা আপনাকে ঠিক দাম দিতে চাই। জমিটা দয়া করে আমাদের দিন।
অবিনাশ বলেন, আপনাদের তো বললাম, বায়না নেবার পর তা আর হয় না। তা ছাড়া বেশি টাকার আমার দরকার নেই। স্ত্রী মারা গেছেন বছর পাঁচেক আগে। এক ছেলে, এক মেয়ে। মেয়ে থাকে বাঙ্গালোরে, ছেলে আমেরিকায়। লস এঞ্জেলেসে ছেলে বিরাট বাড়ি করেছে, অঢেল রোজগার। সে আমাকে একা একা এখানে থাকতে দিতে চায় না। দু-চার মাসের ভেতর এসে আমাকে নিয়ে যাবে। তার আগে এখানকার জমিজমা বেচে দিতে চাই। মানুষটি ভারি সরল, নইলে নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা দুই অচেনা তরুণ তরুণীকে এভাবে জানাতেন না।
অবিনাশ আরো বলেন, যে বাড়িতে বসে আমরা কথা বলছি সেটা দেব আমার এক ভাইপোকে। তারপর একেবারে মুক্তপুরুষ হয়ে আমেরিকায় পাড়ি।
রণিতারা তো আর জমি কিনতে আসে নি, নানা কথা বলে ঐ পাঁচ কাঠা জমির আসল রহস্য বার করে নিতে চায়। সে জিজ্ঞেস করে, ঐ আঠারো নম্বরের জমিটা কারা কিনছেন?
অবিনাশ একটু মজা করে বলেন, কেন, আপনারা কি তার কাছে গিয়ে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ওটা নিতে চান?
না। এমনি কৌতূহল আর কি।
মমতা রায় নামে এক ভদ্রমহিলা মহৎ উদ্দেশ্যে ওটা কিনছেন, সেই জন্যে আমিও কম দামে রাজি হয়ে গেলাম। নইলে অনেক বেশি টাকার অফার এসেছিল।
নয়নতারার নামে জমিটা বায়না হয় নি। আসল নামে তিনি তা হলে জমিটা কিনছেন? রণিতা জিজ্ঞেস করে, আপনি মমতা রায়কে দেখেছেন?
অবিনাশ বলেন, না। ওঁর লোক এসে বায়না করে গেছেন। তাকে পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি দেওয়া আছে। তিনি দু-এক সপ্তাহের ভেতর আলিপুরে জমি রেজিস্ট্রি করিয়ে নেবেন।
মহৎ উদ্দেশ্যের কথা কী বলছিলেন?
মমতা রায় ঐ জমিটায় ডেস্টিটিউট মেয়েদের জন্যে একটা বড় হোম করতে চান।
ও। সত্যিই নোবল কজ।
আরো কিছুক্ষণ কথা বলে অবিনাশ তরফদারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাস্তায় চলে আসে রণিতারা। বিজন সেতুর দিকে হাঁটতে হাঁটতে অমিতেশ বলে, একটা ব্যাপার আমার গুলিয়ে যাচ্ছে রণি–
রণিতা বলে, কী?
নয়নতারা গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডের সেন্টার স্টেজে এতকাল ছিলেন, হঠাৎ তিনি সেখান থেকে মেয়েদের জন্য বাড়ি করতে চাইছেন কেন?