স্থির চোখে দু-এক পলক অমিতেশের দিকে তাকিয়ে থাকে রণিতা। তারপর তাড়া দিতে দিতে বলে, টেপটা আমাকে দাও–
অবাক হয়ে অমিতেশ জিজ্ঞেস করে, কেন?
ওটা আমার কাছে থাকবে।
আমার কাছে থাকলে অসুবিধাটা কী?
কখন নয়নতারার ওপর রাগ করে ইন্টারভিউটা ছেপে দেবে তার কি কিছু ঠিক আছে? এমন একটা লোভনীয় মেটিরিয়াল হাতের মুঠোয় থাকলে কোনো জার্নালিস্ট কি মাথা ঠিক রাখতে পারে? দিয়ে দাও বলছি–
একরকম জোর করেই টেপ রেকর্ডারটা কেড়ে নেয় রণিতা।
টেপটা হাতছাড়া হওয়ায় গুম হয়ে গিয়েছিল অমিতেশ। তার বেজার মুখ দেখে রণিতা এবার বলে, তোমাদের জানলিস্টদের এই এক দোষ, ধৈটা বড্ড কম। কিছু একটা পেলে টাটকা টাটকা সেটা ইউজ করে সেনসেসন ক্রিয়েট করতে চাও। টেপের মেটিরিয়ালটা ধরে রাখলে ভবিষ্যতে আরো অনেক বড় ব্যাপারে কাজে লাগানো যেতে পারে।
অমিতেশের এবার মনেহয় ঠিকই বলেছে রণিতা।ধরা যাক,হঠাৎনয়নতারার মৃত্যু হল কিংবা তিনি নতুন করে ফের অভিনয়ের জগতে ফিরে এলেন, তখন এই টেপটা যে কী মূল্যবান হয়ে উঠবে ভাবা যায় না। এখন ছাপলে কিছুটা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হবে ঠিকই কিন্তু তার রেশ খুব বেশিদিন থাকবে না। নয়নতারাকে ঘিরে ভবিষ্যতে যদি বড় মাপের ঘটনা ঘটে তখন এই টেপটার এফেক্ট হবে সুদূরপ্রসারী।
অমিতেশ বলে, ঠিক আছে, তোমার কথামতো লোভটা এখন সামলেই রাখি।
কথায় কথায় ওরা একটা মোড়ের মাথায় চলে এসেছিল। এখান থেকে একটা রাস্তা চলে গেছে নিউ আলিপুরের দিকে, একটা রাজা সন্তোষ রোডের দিকে, আরেকটা রাসবিহারীতে। দু মিনিটও দাঁড়াতে হল না, রণিতারা ফাঁকা অটো পেয়ে যায়। রাসবিহারীর দিকে যেতে যেতে রণিতা বলে, এই যা, দারুণ একটা ভুল হয়ে গেল তো।
অমিতেশ বলে, কী?
ডকু-ফিচারটা যে করা যাবে না, বিন্দুবাসিনী মাসিমাকে সেটা জানিয়ে আসা উচিত ছিল।
বাড়ি গিয়ে একটা ফোন করে দিও।
তা তো দিতেই হব। তবে ওঁর সঙ্গে দেখা না করে আসার জন্যে খুব ক্ষুব্ধ হবেন।
অমিতেশ আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে, তা হবেন।
আসলে নয়নতারাকে মাঝখানে রেখে প্রীতি স্নেহ বন্ধুত্ব শ্রদ্ধা–সব মিলিয়ে বিন্দুবাসিনীর সঙ্গে তারা জড়িয়ে গেছে। নয়নতারাকে খুঁজে বার করা, তাঁকে নিয়ে ডকু-ফিচারের পরিকল্পনা–এ সবের জন্য যে টিমটা তৈরি হয়েছে তিনি তার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মেম্বার।
রণিতা বলে, ফোন তো আজ করবই, কাল তুমি আর আমি এসে একবার ওঁর সঙ্গে দেখাও করে যাব।
সব শুনলে উনি ভীষণ শকড হবেন।
হুঁ।
চেতলা ব্রিজ পার হয়ে অটোটা কেওড়াতলার মুখে এসে ট্রাফিক জ্যামের ফাঁদে আটকে যায়। চারদিকে অজস্র গাড়ি এমনভাবে জট পাকিয়ে গেছে যে আধ ঘণ্টার আগে রাস্তা ফাঁকা পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। এখান থেকে রাসবিহারীর মোড় পর্যন্ত হেঁটে গেলে তিন চার মিনিট লাগবে। ভ্যাপসা গরমে অটোর ভেতর বসে থাকার মানে হয় না। ওরা ভাড়া মিটিয়ে নেমে পড়ে।
চলতে চলতে রণিতা বলে, আমি একটা কথা ভাবছিলাম।
জিজ্ঞাসু চোখে তাকায় অমিতেশ, কী?
রণিতা বলে, দু-একদিনের ভেতর কসবায় গিয়ে আঠারো নম্বর রজনী দত্ত রোডের জায়গাটা সম্পর্কে খোঁজ নেব।
অমিতেশ চকিত হয়ে ওঠে, যেটা নয়নতারা কিনে নেবার জন্যে সমরেশ ভৌমিককে ফোনে বায়না করতে বললেন?
হ্যাঁ।
শুধু শুধু এর পেছনে সময় নষ্ট করার দরকার কী?
ধর নিছক কৌতূহল।
অমিতেশ রণিতাকে লক্ষ করতে করতে বলে, বিশুদ্ধ কৌতূহলের জন্যে তুমি কসবায় ছুটবে, তা কিন্তু আমার মনে হয় না।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে রণিতা। তারপর যা বলে তা এইরকম। নয়নতারার মতো একজন সুপারস্টার সম্পর্কে প্রচুর তথ্য জোগাড় করেছে সে, তার বিস্তর ছবি দেখেছে, একটা নাটকের ভিডিও ক্যাসেটও। তবু তাঁর জীবনের নানা দিক এবং নানা রহস্য এখনও অজানাই থেকে গেছে। গ্ল্যামার জগতের মক্ষিরানী বত্রিশটি মেয়ের থাকার জন্য কেন গোপনে একটা বাড়ি বানিয়ে দিতে চাইছেন সেটা জানার খুব ইচ্ছা রণিতার। এই মেয়েরা কারা, সম্ভব হলে তাদেরও খুঁজে বার করবে।
রণিতা বলে, ব্যাপারটা হল, একজন লিজেন্ডারি নায়িকার জীবনের খানিকটা আমরা জেনেছি। বাকিটা জানতে না পারলে ওঁর সম্পর্কে আমাদের ধারণাটা ইনকমপ্লিট থেকে যাবে।
আর জেনে কী হবে? কোনো লাভ তো নেই।
আর্থিক লাভের কথা আমি ভাবছি না। ধর এটা আমার স্যাটিসফ্যাকশান।
একসময় ওরা রাসবিহারীর মোড়ে এসে পড়ে।
১৬-২১. বাড়ি ফিরে
বাড়ি ফিরে বিন্দুবাসিনীকে সেদিনই ফোন করেছে রণিতা। ডকু-ফিচারটা করা যাবে না শুনে ভীষণ হতাশ হয়ে পড়েছেন তিনি। বলেছেন, ওটা হল না বলে তাঁর সঙ্গে সম্পর্কটা যেন নষ্ট না হয়, রণিতারা যেন যোগাযোগটা রাখে এবং সময় পেলে ও আলিপুরে তাঁর কাছে চলে আসে। রণিতা জানিয়েছে, অবশ্যই যাবে এবং তাদের সম্পর্কটা চিরকাল বজায় থাকবে।
সেদিন রাতে ইন্দ্রনাথকেও তার ব্যর্থতার কথা জানিয়েছে রণিতা। বাবা কিন্তু চূড়ান্ত আশাবাদী, মেয়েকে তিনি উৎসাহই দিয়েছেন। তাঁর ধারণা শেষ পর্যন্ত নয়নতারা মত পালটাবেন কিন্তু বাবার মতো রণিতা অতটা আশান্বিত হতে পারে নি। নয়নতারাকে যেটুকু সে দেখেছে তাতে নিজের সিদ্ধান্ত থেকে এক চুল নড়বেন কিনা সন্দেহ।
মাঝখানে দিল্লি থেকে রজনীও একবার ফোন করেছিল। কাজটা কতদূর এগিয়েছে সেটা জানার জন্য সে প্রচণ্ড আগ্রহী। তাকে অবশ্য পরিষ্কার করে সবটা জানায় নি রণিতা, শুধু বলেছে আপাতত নানা কারণে ডকু-ফিচারটা করা যাচ্ছে না, দিনকয়েক পর ফোন করে বলবে কবে ওটা শুরু করা সম্ভব। শুনে প্রথমটা নিরাশ হয়ে পড়েছে রজনী, তারপর গলায় বেশ জোর দিয়ে বলেছে, ছবিটা তোকে করতেই হবে। শুটিং আরম্ভ হলে আমি কদিন কলকাতায় গিয়ে থাকব।