ঝোঁকের মাথায় বলতে বলতে হঠাৎ সচেতন হয়ে থমকে যান নয়নতারা। হয়তো তাঁর মনে হয়, অনেক বেশি বলা হয়ে গেছে। এতটা বিস্ফোরণের প্রয়োজন ছিল না। নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়ে বলেন, তোমরা এখন যেতে পার।
রণিতা হতাশ গলায় বলে, ডকু-ফিচারটার কী হবে?
কিছুই হবে না, আমি রাজি নই।
কিন্তু দেশের মানুষের আপনার সম্বন্ধে কতটা আগ্রহ, কতটা শ্রদ্ধা তা বোধহয় আপনার জানা নেই। এসব উপেক্ষার জিনিস নয়। আপনি কি একবার ভেবে দেখবেন? আমরা না হয় অন্য দিন এসে জেনে যাব।
নয়নতারা বলেন, না। আট বছর সবার সামনে থেকে দূরে সরে এসে নিজের মত করে আমি বেঁচে আছি। ডকু-ফিচার মানেই নতুন করে মানুষের নজর আবার আমার ওপর এসে পড়বে। আবার খবরের কাগজ, টিভি, রেডিওর ঝাট। আমার শান্তি নষ্ট হোক, এটা আমি কিছুতেই হতে দেব না। প্লিজ কুইট।
পকেট থেকে একটা কার্ড বার করে সেন্টার টেবলে রেখে রণিতা বলে, এটা থাকল। যদি ডকু-ফিচারের ব্যাপারে কখনও আপনার সিদ্ধান্ত পালটায় দয়া করে ফোন করবেন।
পালটাবে না।
কিছুক্ষণ চুপচাপ।
তারপর নয়নতারা বলেন, তোমরা হয়তো আমার ওপর রেগে গেলে। তবু একটা অনুরোধ করব।
রণিতা বলে, রাগ করব কেন? আপনার অনুরোধটা কী?
এই সময় টেলিফোন বেজে ওঠে।
নয়নতারা বলেন, এক মিনিট–কপা এগিয়ে সেই নিচু স্ট্যান্ডটা থেকে ফোন তুলে জিজ্ঞেস করেন, কাকে চান–ও সমরেশ–
চকিতে রণিতা আর অমিতেশ পরস্পরের দিকে তাকায়। ঐ নামটা তাদের অজানা নয়। সেদিন যে বেনামা চিঠিটা এসেছিল তাতে নয়নতারার প্রিয় বন্ধু এবং অন্ধ অনুরাগী সমরেশ ভৌমিকের কথা সাতকাহন করে লেখা ছিল। নিজেদের অজান্তেই তাদের সমস্ত স্নায়ু টান টান হয়ে যায়। যে লোকটি আট বছর আগে ঘর সংসার ফেলে রেখে অদ্ভুত এক নেশার ঘোরে নয়নতারার সঙ্গে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল, এতকাল বাদে তাদের দুজনের সম্পর্কটা কতখানি বজায় রয়েছে সেটা বোঝার জন্য টেলিফোনের দিকে কান খাড়া করে রাখে। অবশ্য রণিতারা বাইনোকুলার দিয়ে এ বাড়িতে আগেই সমরেশ ভৌমিককে একবার দেখেছে। সম্পর্কটা ভাল না থাকলে নয়নতারা কি তাঁকে বাড়িতে ঢুকতে দিতেন?
নয়নতারা বলছিলেন, কসবার কোন জমিটা?.. আঠারো নম্বর রজনী দত্ত রোডেরটা কি?….ও পাঁচ কাঠা… চারতলা বাড়ি করতে হবে…বত্রিশটি মেয়ের শেলটার ওর কমে কুলোবে না…বায়না করে নাও..জমির টাকাটা আমিই দিতে পারব…কিন্তু বাড়ি করার মতো অত টাকা আমার নেই..হাঁ, কিছু একটা করতেই হবে….অতগুলো হেল্পলেস মেয়ে….কবে আসছ?…. কাল বিকেলে.ঠিক আছে, ঠিক আছে…কাল সকালে তোমার ফ্ল্যাটে ফোন করব…আর কী…ও হ্যাঁ হ্যাঁ…ওখানে ওষুধ কিনে দিও…তোমার কাছে হাজার দুই টাকা আছে তো..পরে দেখা যাবে…।
কসবায় জমি কিনে একটা বাড়ি করতে চান নয়নতারা, এটুকু বোঝা গেল। আর জানা গেল, সমরেশ ভৌমিক আঁর সঙ্গে এ বাড়িতে থাকেন না। সমরেশের আলাদা ফ্ল্যাট আছে। যে বত্রিশটি সহায়সম্বলহীন মেয়ের জন্য একটা বাড়ি করার উদ্যোগ নিয়েছেন নয়নতারা তারা কারা? সেটা ধরা গেল না। কথাবার্তা শেষ করে ফোন নামিয়ে রণিতাদের কাছে ফিরে আসেন নয়নতারা। বলেন, তোমাদের অনেকক্ষণ আটকে রাখলাম। হঠাৎ ফোনটা এসে গেল কিনা–
রণিতা বলে, ঠিক আছে। আপনার কী একটা অনুরোধ আছে–
নয়নতারা বলেন, হ্যাঁ। আমি যে এখানে আছি সেটা জানাজানি যেন না হয়। তোমাদের পোপোজালে রাজি হই নি। আশা করি মনের ক্ষোভে এমন কিছু করবে না যাতে আমি বিপন্ন হয়ে পড়ি।
আপনাকে তো সেদিনই বলে গেছি আমাদের ওপর আস্থা রাখতে পারেন, আমরা বিট্রে করব না। আচ্ছা নমস্কার।
নমস্কার।
বাড়িটা থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে হতাশ ভঙ্গিতে অমিতেশ বলে, তিনটে মাস এত খাটুনি আর চারদিকে ছোটাছুটিই সার হল।
অমিতেশের পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে রণিতা কিছু ভাবছিল। অন্যমনস্কর মতো বলে, হুঁ–
এবার কী করবে?
দেখি।
মান্ডি হাউসকে তো জানিয়ে দিয়েছিলে ডকু-ফিচারটা করতে পারবে এখন ওদের কী বলবে?
কটা দিন ওয়েট করি। যদি নয়নতারার মত বদলায়, ফাইন। নইলে চিঠি লিখে জানিয়ে দেব, আমার পক্ষে সম্ভব হল না।
অমিতেশের মনে প্রচুর ক্ষোভ জমা হচ্ছিল। সে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল নয়নতারা ডকু-ফিচারের ব্যাপারে আপত্তি তো করবেনই না, বরং তাঁর কাছ থেকে সবরকম সহযোগিতা পাওয়া যাবে। কিন্তু তিনি তাদের আন্তরিকতা এবং এতদিনের পরিশ্রমকে একেবারেই মর্যাদা দিলেন না।
অমিতেশ একটু ইতস্তত করে বলে, তোমাকে না জানিয়ে একটা কাজ করেছি।
কী? রণিতা জানতে চায়।
পকেটে একটা ছোট পাওয়ারফুল টেপ রেকর্ডার নিয়ে গিয়েছিলাম। ওটা চালিয়ে নয়নতারার কথাগুলো রেকর্ড করে নিয়েছি। তার ওপর বেস করে ওঁর সাক্ষাৎকার ছেপে দেব নাকি? ফার্স্ট ইন্টারভিউ অফ নয়নতারা আফটার এইট ইয়ারস অফ সাইলেন্স–
রণিতা চমকে ওঠে, না না। ওঁকে কথা দিয়েছি, বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারব না। না জানিয়ে ওঁর কথা টেপ করে খুব অনায় করেছ। দিস ইজ আনএথিক্যাল।–
অমিতেশ তাকে বোঝাতে চেষ্টা করে, আরে বাবা, আমরা কাগজের লোক, যে কোনো ভাবেই খবর জোগাড় করাটা আমাদের কাজ। অত এথিকসের ধার ধারলে কাগজ বন্ধ করে দিতে হবে। একটু থেমে ফের বলে, ইন্টারভিউটা ছাপা হলে অন্তত নিজেকে বোঝাতে পারব, আমাদের এতদিনের লেবারটা একেবারে মিনিংলেস হয়ে যায় নি।