রজনী বলে, ওকে ওকে। দুমিনিট হয়ে গেছে। এবার শোন, তোর জন্যে একটা দারুণ সুখবর আছে, এক্সট্রিমলি গুড নিউজ।
এক্সট্রিমলি শব্দটার ওপর এমন জোর দেয় রজনী যে শিরদাঁড়া টান টান করে বসে রণিতা। বলে, কী খবর রে?
কাল মাণ্ডি হাউস-এ আমার একটা টেলিফিল্মের ব্যাপারে গিয়েছিলাম। তখন তোর পোপোজালগুলো সম্পর্কে খোঁজ নিলাম–
রণিতার মনে পড়ে মাস ছয়েক আগে সে দুটো টেলিফিল্ম এবং দুটো ডকুমেন্টারি বা তথ্যচিত্রের স্ক্রিপ্ট জমা দিয়েছিল। রজনীকে বলে এসেছিল, মাঝে মাঝে গিয়ে যেন ওগুলো সম্পর্কে খবর টবর নেয়–অ্যাপ্রুভাল পাওয়া যাবে কিনা, পেলে কতদিন লাগবে, ইত্যাদি। রণিতা জিজ্ঞেস করে, কী বললেন ওঁরা?
রজনী বলে, ওগুলো যেমন দিয়েছিলি তেমনি পড়ে আছে অ্যান্ড অ্যাজ ইয়ুজুয়াল গ্যাদারিং ডাস্ট। তবে ওঁদের দিক থেকে একটা অফার দিয়েছেন।
কী অফার?
ওঁরা তোকে দিয়ে একটা ডকু-ফিচার করাতে চান।
গত তিন বছরে ডকুমেন্টারি ছবি করে দেশের তো বটেই, বাইরেও কম করে সাত আটটা পুরস্কার পেয়েছে রণিতা। সে যে আর সব তথ্যচিত্র-করিয়েদের থেকে আলাদা, তার দেখার চোখ, ক্যামেরার ব্যবহার, ছিমছাম এডিটিং ডকুমেন্টারিগুলোকে যে শিল্পের স্তরে তুলে নিয়ে যায়, এ নিয়ে কাগজে কাগজে প্রচুর লেখালিখি হয়েছে। মাণ্ডি হাউস তার সম্বন্ধে সব খবরই রাখে।
রণিতা জিজ্ঞেস করে, কিসের ডকু-ফিচার? সাবজেক্টটা কী?
নয়নতারা।
নয়নতারা? আই মিন–
রজনী বলে, ইয়া বাবা, ইন্ডিয়ান স্টেজ আর স্ক্রিনের লিজেন্ডারি নায়িকা– লাস্ট পঞ্চাশ বছরের মধ্যে যাঁর মতো আর্টিস্ট আর আসেনি।
কথাটা ঠিকই বলেছে রজনী। বাংলা সিনেমা আর নাটকে মূলত অভিনয় করলেও নয়নতারা হিন্দি ছবি আর নাটকও করেছেন প্রচুর। এর প্রায় সবগুলোই সারা দেশকে তোলপাড় করে দিয়েছে। চার চারবার উর্বশী অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন, বিদেশের কয়েকটি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে বেস্ট অ্যাকট্রেস হিসেবে সম্মানিত হয়েছেন, অসামান্য শিল্পী হিসেবে দেওয়া হয়েছে পদ্মভূষণ খেতাব। সারা দেশ জুড়ে তাঁর অজস্র অনুরাগী, কত যে ফ্যানক্লাব নয়নতারার নামে তৈরি হয়েছে তার হিসেব নেই। বিপুল জনপ্রিয়তা এবং মর্যাদা দুই-ই পেয়েছেন তিনি। কিন্তু তাঁকে নিয়ে ছবি করা অকল্পনীয় ব্যাপার।
রণিতা হকচকিয়ে গিয়েছিল। বলে, ইমপসিবল রাজু, অ্যাবসোলুটলি ইমপসিবল।
রজনীর তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, হোয়াই? তোর মতো ডেয়ারিং ডেসপারেট মেয়ের কাছে এমন একটা শব্দ এক্সপেট করিনি।
রজনীর মতো হৈ-হুল্লোড় করতে না পারলেও রণিতা ভীষণ জেদি, প্রচণ্ড একলোখা আর সাহসী। কিছু একটা মাথায় চাপলে সেটা না করে ছাড়ে না। ভারতবর্ষের নানা দুর্গম জায়গায় ঘুরে ঘুরে এমন জটিল, দুরূহ সব বিষয় নিয়ে সে ছবি করেছে, মেয়েরা তো বটে, অনেক পুরুষ ফিল্মমেকারও তা ভাবতে পারে না।
রণিতা বলে, কেন অসম্ভব, জানিস না। আট বছর আগে তিনি নিরুদ্দেশ হয়েছেন। মিডিয়ার লোকেরা পাগলের মতো তাঁকে খুঁজে বেড়িয়েছে, কিন্তু কোথাও পাওয়া যায়নি। তাঁকে নিয়ে করব অথচ তিনিই থাকবেন না, এটা তত হতে পারে না।
অফ কোর্স। ওঁকে খুঁজে বার কর। আর দেরি করলে ইট উড বি টু লেট। অন্য কান্ট্রি হলে এতদিনে ওঁর ওপর পঁচিশটা ডকুমেন্টারি হয়ে যেত। শোন, টাকাটা কোনো ফ্যাক্টর নয়, নয়নতারাকে নিয়ে লন্ডন কি নিউইয়র্কে শুটিং করলেও ওঁরা সব খরচ দেবেন। মোটামুটি একটা বাজেট তৈরি করে দিন পনেরো পর দিল্লি চলে আয়।
একটু ভেবে রণিতা বলে, ছবিটা তুইই কর না।
রজনী বলে, আরে বাবা, বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজটা কি আমি ভাল জানি? উনি বেশির ভাগ কাজই করেছেন বাংলা ফিল্ম আর স্টেজে। ল্যাংগুয়েজ না জানলে ফাইনার ব্যাপারগুলো ধরব কী করে?
কিন্তু–
কিন্তু ফিন্তু না, ইটস আ চ্যালেঞ্জিং জব। এটা তোকে করতেই হবে। দ্যাট গ্রেট লেডি, নয়নতারা রায়, কিভাবে স্টেজ আর ফিল্ম অ্যাক্টিংয়ে এলেন, কে বা কারা তাঁকে ইন্সপায়ার করেছে, কেমন ছিল তাঁর ডে-টু-ডে লাইফ, কেনই বা তিনি হঠাৎ সব ছেড়েছুঁড়ে নিরুদ্দেশ হলেন, এর সঙ্গে ইলাস্ট্রেশন হিসেবে যে সব ছবিতে আর নাটকে তিনি অভিনয় করেছেন তার কিছু ক্লিপিং জুড়ে দিতে পারলে দারুণ একটা ব্যাপার হবে।
রণিতা উত্তর দেয় না।
রজনী থামেনি, শুনেছি, ওঁর পারিবারিক জীবনে প্রচণ্ড অশান্তি ছিল। অনেকে ওঁর ক্ষতি করতে চেয়েছেন। ওঁকে নিয়ে এক সময় থাউজেন্ড অ্যান্ড ওয়ান স্ক্যান্ডাল রটেছে। সব বাধা পার হয়ে কিভাবে আজকের এই হাইটে উঠেছেন, এগুলোও ছবিটায় থাকা চাই।
রজনী নানাভাবে উদ্দীপ্ত করে তুলতে চাইছে কিন্তু রণিতার সংশয় কিছুতেই কাটছে না। সে বলে, তা তো চাই। তবে–
তার কথা কানেও তোলে না রজনী। নন-স্টপ টকিং মেশিনের মতো একটানা বলে যায়, আমাদের ইন্ডিয়ানদের মতো এমন ক্যালাস, ইনডিফারেন্ট জাত হোল ওয়ার্ল্ডে আর দ্বিতীয়টি নেই। এত বড় একজন আর্টিস্ট সম্বন্ধে এখনই যদি কিছু করে না রাখি ফিউচার জেনারেশন আমাদের গায়ে থুতু দেবে। একটু থেমে দম নিয়ে ফের শুরু করে, আমরা হয়তো কিছু করলাম না কিন্তু দেখবি হুট করে ইয়োরোপ আমেরিকা থেকে কেউ এসে কাজটা করে ফেলল। দে আর মাচ মোর এন্টারপ্রাইজিং। তখন আর কারো কাছে মুখ দেখানো যাবে না। আ শেম ফর অল অফ আস।