নয়নতারা বলেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, এরকম কী যেন বলেছিলে। আর তুমি?
আমি পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে চার বছর আগে পাস করে বেরিয়েছি। আমার সাবজেক্ট ছিল ফিল্ম ডিরেকশান। এখন শর্ট ফিল্ম মানে ডকুমেন্টারি ধরনের ছবি করছি। বলে সোজাসুজি নয়নতারার দিকে তাকায় রণিতা।
নয়নতারা কিছু মনে করার চেষ্টা করেন। তারপর বলেন, দিন পনেরো আগে আসামের মিকির ট্রাইবকে নিয়ে তোমার একটা ডকুমেন্টারি কি টিভিতে দেখানো হয়েছিল?
আপনি দেখেছেন! রণিতার চোখমুখ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।
নিশ্চয়ই। নয়নতারা বলেন, এখন তো আমার প্রচুর অবসর। টিভি দেখে দেখে অনেকটা সময় কাটিয়ে দিই। একটু থেমে বলেন, আজকাল মেয়েরা ফিল্ম ডিরেকশনে আসছে, এটা খুব ভাল ব্যাপার। এই ফিল্ডটাতেও পুরুষদের মনোপলি ভাঙছে। মেয়েরা আর কোনো দিকেই পিছিয়ে থাকছে না। বলে সকৌতুকে অমিতেশের দিকে তাকান। বিশাল হলঘরটায় পুরুষ জাতির একমাত্র প্রতিনিধি অমিতেশ, দেখা গেল, মেয়েদের এই অগ্রগতিতে তার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। নয়নতারার বলার ভঙ্গিতে সেও হেসে ফেলে।
নিজের ডকুমেন্টারিটা সম্পর্কে নয়নতারার মন্তব্য শোনার জন্য ভেতরে ভেতরে উদগ্রীব হয়ে উঠছিল রণিতা। সে জিজ্ঞেস করে, আমার ছবিটা কেমন লাগল?
নয়নতারা বলেন, চমৎকার। ওটা করার জন্যে তোমাকে বেশ রিসার্চ করতে হয়েছে, তাই না?
রণিতা জানায়, ছমাস মিকিরদের নিয়ে লেখা নানা বইপত্র পড়েছে সে, লামডিংয়ে গিয়ে একটা মিকির গ্রামে তিন মাস কাটিয়ে ওদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা খুঁটিয়ে লক্ষ করেছে, তারপর ছবির কাজে হাত দিয়েছে।
সেই জন্যেই ছবিটা এত টাচিং, ডিটেলের কাজ এত ভাল।
একটু চুপচাপ।
তারপর নয়নতারা রণিতাকে বলেন, আশা করি এ কদিনে তোমার নাভাসনেস কেটে গেছে। আমার বাড়িতে হানা দেবার কারণটা আজ নিশ্চয়ই জানাবে।
রণিতা বলে, হ্যাঁ। নয়নতারাকে নিয়ে ডকু-ফিচারের যে পরিকল্পনাটা করেছে সেটা জানিয়ে সে বলে, আমার ধারণা, আপনি আমাকে সাহায্য করবেন।
নয়নতারার চেহারাটা পলকে আদ্যোপান্ত বদলে যায়। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে কণ্ঠস্বর অনেকটা উঁচুতে তুলে রুক্ষভাবে তিনি বলেন, অসম্ভব–
রণিতা ভয় পেয়ে যায়। বলে, আপনার মতো একজন গ্রেট আর্টিস্ট–
আঙুল তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে নয়নতারা বলেন, স্টপ ইট, প্লিজ স্টপ। আট বছর আমি দূরে সরে নিজের মতো করে বেঁচে আছি। বাইরের ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে আমার কোনোরকম যোগাযোগ নেই। বিশেষ করে প্রিন্ট আর অডিও ভিসুয়াল মিডিয়ার লোকেদের আমি অপছন্দ করি। আমি চাই না তারা আমার শান্তিভঙ্গ করুক।
রণিতা কিছু বলার চেষ্টা করে কিন্তু তার সুযোগ পায় না। তার আগে ফের একই সুরে নয়নতারা বলে যান, তোমরা বিন্দুবাসিনী দেবীদের বাড়ি থেকে চোখে দূরবীন লাগিয়ে দিনের পর দিন আমাকে খুঁজতে, সে জন্যে একটু কৌতূহল হয়েছিল, তাই এ বাড়িতে ঢুকতে দিয়েছিলাম। কিন্তু তোমাদের এরকম একটা ইনটেনসান রয়েছে, তখন জানতাম না।
জানলে কি ঢুকতে দিতেন না?
আমার জবাব–অবশ্যই না। তোমরা মিডিয়ার লোকেরা আমার প্রচুর ক্ষতি করেছ। তোমাদের সঙ্গে আমি কোনোরকম সম্পর্ক বাখতে চাই না।
রণিতা বুঝতে পারছিল, যে কোনো কারণেই হোক, মিডিয়ার ওপর নয়নতারা খুবই অসন্তুষ্ট। হয়তো সেখান থেকে তিনি কোনো আঘাত পেয়েছেন আর সেটা তাঁর মাথায় চেপে বসে আছে, কিছুতেই ভুলতে পারছেন না। যেভাবে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে আছেন তাতে ডকু-ফিচারটার আশা আর নেই। রণিতা প্রায় মরিয়া হয়ে ওঠে, আপনি মিডিয়াকে ঘৃণা করেন?
থমথমে মুখে নয়নতারা বলেন, ইয়েস, আই ডু।
কিন্তু–
আবার কী? তোমকে তো পরিষ্কার বলে দিলাম–আই হেট, আই হেট, আই হেট–
রণিতা উঠে দাঁড়ায়। বলে, একটা কথা ভেবে দেখেছেন?
নয়নতারা বলেন, কী ভাবার কথা বলছ?
আপনি আজ যা, তার সবটুকুই মিডিয়ার তৈরি। দিনের পর দিন কাগজে আপনার সম্বন্ধে লিখে, অজস্র ছবি ছেপে, টিভিতে অনবরত আপনার ফিল্ম দেখিয়ে, রেডিওতে আপনার সম্পর্কে বলে বলে একটা লিজেন্ড বানিয়ে দিয়েছে। আপনাকে ঘিরে আজ এত যে মিথ সেটা মিডিয়ারই জন্যে। ইউ আর মিডিয়া ক্রিয়েটেড। আর বলছেন কিনা আপনি আমাদের ঘৃণা করেন!
রণিতা যে এভাবে বলতে পারে, ভাবতে পারেন নি নয়নতারা, একটু থমকে যান তিনি। পরক্ষণে বলে ওঠেন, কে চেয়েছিল ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে মিথ বানিয়ে আমাকে সুপার হিউম্যান করে তুলতে? আসলে কাগজ যাতে বেশি কাটে, রেডিও আর টিভির যাতে আকর্ষণ বাড়ে সেই জন্যে আমাকে লিজেন্ড তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু আমি তা চাই নি।
কী চেয়েছিলেন আপনি?
একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে।
এরপর কী বলা উচিত, রণিতা ঠিক করতে পারছিল না। এত গ্ল্যামার, এত মিথ, কোটি কোটি মানুষের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে দিনের পর দিন থেকে যাওয়া–একজন চিত্রতারকার কাছে এসব যে সেভাবে কাম্য নয়, এই প্রথম জানতে পারল রণিতা। অবাক চোখে সে নয়নতারার দিকে তাকিয়ে থাকে।
নয়নতারা বলে যাচ্ছিলেন, মিডিয়া আমার কী করেছে ভাবতে পার? আট বছর আগে আমি কোথাও বেরুতে পারতাম না, কারো সঙ্গে মিশতে পারতাম না। লক্ষ লক্ষ মানুষের চোখ তখন আমার দিকে, হাজার হাজার ক্যামেরা আমাকে ফলো করে যাচ্ছে। ফ্রিলি নিশ্বাস নিতে পারি না, স্বাভাবিক জীবনযাপন বলতে আমার কিছুই নেই। বানিয়ে বানিয়ে অসংখ্য স্ক্যান্ডাল বানিয়ে মদের চাটের মতো বিলানো হচ্ছে। আমার প্রাইভেসি বলতে কিছু নেই। ঘরের ভেতর কী করি, ঘরের বাইরে কোথায় যাই, সব পরদিন খবরের কাগজের প্রথম পাতায় ছাপা হয়ে যায়। এমন সব কুৎসাও বেরোয় যার সঙ্গে আমার কোনো সংস্রব নেই। তোমরা আমার নিজস্ব ওয়ার্ল্ড বলতে কিছু রাখো নি, বাইরের ওয়ার্ল্ডও কেড়ে নিয়েছ।