সে তো এখন নিজের চোখেই দেখলাম। আগে কানেও শুনেছি।
নয়নতারা একটু হাসেন, একটা সুবিধে হয়েছে, এই গোপন টেলিফোনটি নয়নতারার নামে নেই। ফলে অনেকেই ধাঁধায় পড়ে যায়–
রণিতা বলে, আমিও পড়েছিলাম। মমতা রায় কে?
আমিই মমতা রায়। ওটা আমার বাবার দেওয়া নাম। আরো একটা নাম আছে আমার– লক্ষ্মী। নয়নতারা আমার স্ক্রিন নেম।
একটু চুপচাপ।
তারপর নয়নতারা ফের শুরু করেন, সে যাক, অন্য যারা ফোন করে বা আমাকে দেখতে চায় তুমি যে তাদের মধ্যে পড় না, সেটা বুঝতে পেরেছি। কেন এত কষ্ট করে এ বাড়িতে ঢুকেছ জানার জন্যে যথেষ্ট কৌতূহল হচ্ছে কিন্তু তুমি তো আজ মুখ খুলবে না। কবে আসতে চাও?
রণিতা বলে, যেদিন আপনি সময় দেবেন।
খানিকক্ষণ চিন্তা করে নয়নতারা বলেন, নেক্সট উইকের বুধবার, সকাল নটায়। অসুবিধে হবে?
একেবারেই না। আপনি যদি মাঝরাতে আসতে বলেন, তাই আসব।
নয়নতারা শুধু হাসেন।
রণিতা বলে, আজ তা হলে আমি যাই?
নয়নতারা বলেন, আচ্ছা। বুধবার পাঁচিল টপকে আসার দরকার নেই, সোজা গেট দিয়ে ঢুকবে। আর–
আর কী? উৎসুক সুরে জানতে চায় রণিতা।
নয়নতারা বলেন, যদি ইচ্ছে হয়, তোমার সেই বয়ফ্রেন্ড বা প্রেমিক ছোকরাটিকেও সঙ্গে আনতে পার। তবে তাকে আমার শর্তটা জানিয়ে দিও। তাঁর চোখের তারায় দুষ্টুমির মতো কিছু একটা নেচে যায়।
.
১৫.
পর পর পাঁচদিন ভোরে জামগাছ থেকে ঝুলে নামতে হয়েছে বটে, লু এত সহজে নয়নতারার কাছে পৌঁছনো যাবে, ভাবতে পারে নি রণিতা। একরকম অযাচিতভাবেই সুযোগটা এসে গেছে। এখন সেটা সুকৌশলে কাজে লাগিয়ে আদৌ ওঁকে ডকু-ফিচারের ব্যাপারে রাজি করানো যাবে কিনা কে জানে। তবে রণিতা শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে যাবে।
নয়নতারার সঙ্গে সেদিন তার কী কথাবার্তা হয়েছে, কেমন ব্যবহার তাঁর কাছে পাওয়া গেছে, সব কিছু সেদিনই রণিতা জানিয়ে দিয়েছিল বিন্দুবাসিনী, অমিতেশ আর ইন্দ্রনাথকে। তিনজনই দারুণ উৎসাহিত। ওঁদের স্থির বিশ্বাস ডকু ফিচারটা করা যাবে এবং সাংস্কৃতিক জগতের সেটা হবে বিরাট এক ঘটনা।
রণিতা তিনজনকেই বার বার নয়নতাবার শর্তের কথাটা মনে করিয়ে দিয়েছে। তাঁর সঙ্গে যে যোগাযোগ হয়েছে সেটা যেন কোনোভাবেই চাউর হয়ে, না যায়। তা হলে চোদ্দ নম্বর রবিনসন স্ট্রিটে আর ঢোকার সম্ভাবনা থাকবে না।
পরের সপ্তাহের বুধবার সকাল নটায় অমিতেশকে সঙ্গে করে রণিত নয়নতারার বাড়ির সামনে এসে কলিং বেল বাজায়। আজও একটা ব্যাগে পুরে ক্যামেরা আর টেপ রেকর্ডার এনেছে সে। যদি কোনোভাবে নয়নতারাকে রাঙি করানো যায়, আজই তাঁর ছবিটবি তুলে, কথাবার্ত রেকর্ড করে প্রাথমিক কাজ শুরু করে দেবে।
গেটের সেই চৌকো জানালাটা খুলে দারোয়ান রণিতাদের দেখে নিঃশব্দে একমুখ হাসে। তারপর গেটটা খুলে দেয়। দুজনে ভেতরে ঢুকে পড়ে।
রণিতাদের কথা নিশ্চয়ই দারোয়ানকে জানিয়ে রেখেছিলেন নয়নতারা নইলে এমন মধুর হাসি তার মুখে দেখা দিত না।
দারোয়ান বলে, মেমসাব উপরমে হ্যায়। যাইয়ে–
রণিতা আর অমিতেশ বাগান ডান দিকে রেখে নুড়ির রাস্তার ওপর দিয়ে বাড়িতে চলে আসে। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে উঠতে রণিতা লক্ষ করে, উত্তেজনায় প্রায় কাঁপছে অমিতেশ। চারদিন আগে এই সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে অবিকল এইরকমই কিছু একটা তারও হয়েছিল।
নয়নতারা তাদের জন্য দোতলার হল-ঘরে একটা সোফায় বসে অপেক্ষা করছিলেন। বোঝা যায়, এর মধ্যে তাঁর স্নান হয়ে গেছে। পরনে ধবধবে সাদা চিকনের কারুকাজ-করা শাড়ি আর তসরের ব্লাউজ। স্নানের পর সব মেয়েকেই। ভারি পবিত্র দেখায়। নয়নতারাকে আলৌকিক কোনো দেবী মনে হচ্ছিল।
নয়নতারা হেসে বললেন, এস এস–বস–রণিতারা বসলে সকৌতুকে অমিতেশের দিকে তাকিয়ে বলেন, তোমার কাজটা কিন্তু কাপুরুষের মতো হয়েছে।
অমিতেশ হকচকিয়ে যায়। বুঝতে না পেরে বলে, মানে—আমি–
বান্ধবীকে পাঁচদিন ভোরে একা একা পাঁচিলের এপারে পাঠিয়ে নিজে হাত-পা গুটিয়ে বসে রইলে। স্ট্রেঞ্জ! বলে চোখ সামান্য কুঁচকে অমিতেশকে লক্ষ করতে থাকেন নয়নতারা।
হতচকিত ভাবটা দ্রুত কাটিয়ে ওঠে অমিতেশ। বলে, ওর সঙ্গে আমারও পাঁচিল টপকানো উচিত ছিল, তাই বলছেন?
রাইট।
আপনার মধ্যে এতটা গ্রেটননস আছে ভাবতে পারি নি, আগে জানলে রণির সঙ্গে প্রথম দিনই পাঁচিল টপকাতাম।
গম্ভীর ভারি গলায় নয়নতারা বলেন, কী ভেবেছিলে, আমার ভেতর যা আছে সবটাই মীননেস–নীচতা?
হতচকিত অমিতেশ সজোরে দু হাত নাড়তে নাড়তে বলে, না না, এ আপনি কী বলছেন।
ঠিক আছে, ঠিক আছে, তোমাকে অত বিব্রত হতে হবে না। ফিল ফ্রি। নয়নতারা কপালে সামান্য ভাঁজ ফেলে হাসেন।
সমস্ত ব্যাপারটাই যে তাঁর মজা, বুঝতে পেরে আরাম বোধ করে অমিতেশ। বলে, আমাকে এমন ঘাবড়ে দিয়েছিলেন–
হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিতে দিতে নয়নতারা বলেন, তোমাদের দুজনের নাম ছাড়া আর কিছুই প্রায় জানি না। কী কর তোমরা?
অমিতেশ দ্রুত একবার রণিতার দিকে তাকায়। অর্থাৎ এক্ষুনি নিজেদের আসল পরিচয়টা দেওয়া ঠিক হবে কিনা, সেটা ওর কাছ থেকে বুঝে নিতে চাইছে। কিন্তু সে কিছু বোঝার আগেই খুব সহজভাবে রণিতা নয়নতারাকে বলে, অমিতেশ সম্পর্কে আপনাকে সেদিন বলেছিলাম। ও একটা কাগজে কাজ করে–রোভিং রিপোটার। মনে পড়ছে?