নয়নতারা অবাক হন না। বলেন, তার মানে তুমিও ফোনে আমাকে ধরতে চেয়েছ?
দু-তিন বার। আর প্রতি বারই ঐ কথাগুলো শুনতে পেয়েছি।
কী করি বল, আমি তো নিবাসনই বেছে নিয়েছি। কারো সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চাই না, তবু কেউ যদি জোর করে গায়ে এসে পড়ে তাকে তো এভাবেই অ্যাভয়েড করতে হয়। এড়িয়ে যাবার আর কোনো মেকানিজম আমার জানা নেই।
কিছুক্ষণ চুপচাপ।
তারপর নয়নতারা বলেন, এবার বল ঐ ছেলেটি তোমার সঙ্গে এল না কেন?
অমিতেশকে আনার অসুবিধাটা কোথায় ছিল বুঝিয়ে দেয় রণিতা। ট্রেসপাসিংয়ের জন্য মেয়ে বলে সে পার পেতেও পারে কিন্তু একজন পুরুষের পক্ষে বিপদটা অনেক বেশি।
নয়নতারা বলেন, তা অবশ্য ঠিক। ছেলেটির কী নাম?
রণিতা অমিতেশের পুরো নামটা পদবিসুন্ধু জানিয়ে দেয়।
নয়নতারার দুই চোখে দুষ্টুমি নাচানাচি করতে থাকে। গলার স্বর আচমকা অনেকখানি খাদে নামিয়ে জিজ্ঞেস করেন, অমিতেশের সঙ্গে তোমার রিলেশানটা কী? বয়ফ্রেন্ড?
লজ্জা পায় রণিতা, জড়ানো আবছা গলায় কিছু একটা বলে যায় যার একটি বর্ণও বোঝা যায় না।
নয়নতারা এবার বলেন, তবে কি লাভার? প্রেমিক?
রণিতার মুখে রক্তোচ্ছাস খেলে যায়।
নয়নতারা বলেন, বুঝেছি। কিছু বলতে হবে না। একটু থেমে ফের বলেন, একটা ব্যাপারে আমার খুব কৌতূহল হচ্ছে রণিতা।
কী?
আমার এই বাড়িটা তোমরা খুঁজে বার করলে কী করে?
কিভাবে খুঁজে পেয়েছে তার অনুপুঙ্খ বিবরণ দিয়ে যায় রণিতা, শুধু খোঁজার কারণটা আপাতত জানায় না। সুযোগ এবং নয়নতারার মুড বুঝে সেই প্রসঙ্গটা তুলবে।
ঘন পালকে-ঘেরা নয়নতারার টানা চোখ দুটি বিস্ময়ে গোল হয়ে যায় বলেন, আরে বাবা, এ যে বিরাট এক্সপিডিশান! বাংলায় কী একটা দারুণ গজা কথা আছে না- ও হ্যাঁ, অধ্যবসায়। তোমাদের দেখছি সেটা যথেষ্ট পরিমাণেই রয়েছে। আমি হলে কিন্তু কিছুতেই পারতাম না।
রণিতা বলে, আপনার মতো একজন শিল্পীর জন্য আমি পৃথিবীর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত যেতে পারি।
ফ্ল্যাটারি?
বিশ্বাস করুন, একেবারেই না।
রণিতার বলার মধ্যে এমন এক আন্তরিকতা রয়েছে যা নয়নতারার বুকের ভেতরকার সূক্ষ্ম তারে আলতো ঝঙ্কার তুলে যায়। মেয়েটিকে তাঁর ভাল লাগতে শুরু করে। হাসিমুখে বলেন, ঠিক আছে, বিশ্বাস করলাম।
একটু চুপচাপ।
তারপর নয়নতারা বলেন, এবার তোমাকে আমি সবচেয়ে ভাইটাল প্রশ্নটা করব।
রণিতা উৎসুক চোখে তাকায়। ভেতরে ভেতরে একটু উৎকণ্ঠাও বোধ করে, যদিও এখন পর্যন্ত নয়নতারাকে যেটুকু দেখেছে তাতে মনে হয়েছে এই কিংবদন্তির নায়িকা রহস্যময় সুদূর নীহারিকায় ভাসমান রঙিন কোনো ফানুস নন, একান্তভাবে চেনা পৃথিবীরই মানুষ–সহৃদয়, সহানুভূতিশীল, স্নেহপ্রবণ। তিনি নিশ্চয়ই তাকে বিপাকে ফেলবেন না।
নয়নতারা বলেন, তোমাকে যেটুকু দেখলাম, কথা বলে যা বুঝলাম, তাতে উন্মাদের মত ফিল্মস্টারের পেছনে তুমি ছুটবে না। তেমন রুচি বা শিক্ষাদীক্ষাও তোমার নয়।
রণিতা তাকিয়েই থাকে।
নয়নতারা থামেন নি, তা হলে এতটা ঝুঁকি নিয়ে রাতের অন্ধকারে এ বাড়িতে ঢুকেছ কেন? উদ্দেশ্য কী তোমার?
দ্বিধান্বিতভাবে রণিতা বলে, আজ বলতে সাহস হচ্ছে না। আমাকে দু একটা দিন সময় দিন।
নয়নতারা সোজাসুজি রণিতার চোখের দিকে তাকান, অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। বলেন, তুমি শুধু ইনটেলিজেন্টই নও, অসম্ভব ধুরন্ধর। আরেক দিন এ বাড়িতে ঢোকার ব্যবস্থা করে রাখতে চাইছ?
শুধু আরেক দিন কেন, আপনার অনুমতি পেলে আরো অনেক, অনেক দিন আমাকে এখানে আসতে হবে।
রেগে উঠতে গিয়ে হেসে ফেলেন নয়নতারা, নটি গার্ল। ভীষণ খলিফা তুমি।
নয়নতারার মুখে খলিফা কথাটা শুনবে ভাবতে পারেনি রণিতা। এসব শব্দ তোত অল্প বয়সের ছেলেমেয়েরা নিজেদের মধ্যে ব্যবহার করে থাকে। দৈখা যাচ্ছে বাড়ির ভেতর নির্বাসন বেছে নিলেও বাইরের অনেক কিছুই তিনি জানেন।
নয়নতারা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একবার তাকে বলেছেন চতুর, একবার ধুরন্ধর, একবার নটি গার্ল এবং খলিফা। পাঁচিল ডিঙোবার জন্য তিনি যে খেপে যান নি তা তো আগেই বুঝে গেছে রণিতা। বরং বেশ মজা পাচ্ছেন, সেটাও তার কাছে আর অস্পষ্ট নেই।
নয়নতারা কিছুক্ষণ ভেবে বলেন, তুমি প্রমিস করেছ আমার কথা বাইরের কাউকে জানাবে না।
রণিতা বলে, করেছি।
সেই শর্তেই তোমাকে আরেক দিন এ বাড়িতে ঢোকার পারমিসান দেব। যদি দেখি শর্ত ভাঙো নি, এখানকার দরজা চিরকালের মতো হয়তো তোমার কাছে খুলেও যেতে পারে।
ধন্যবাদ। আপনাকে কী বলে যে কৃতজ্ঞতা জানাব–
হাত তুলে রণিতাকে থামিয়ে দিতে দিতে নয়নতারা বলেন, ধন্যবাদ বা কৃতজ্ঞতার দরকার নেই। আট বছর স্টেজ আর সিনেমা ওয়ার্ল্ডের বাইরে রয়েছি আমি। তবু এখনও আমাদের দেশের তো বটেই–পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কার বহু মানুষ আমাকে দেখতে চায়, অনেকেই ফোন করে। টেলিফোন ডাইরেক্টরিতে আমার নাম ছাপা হয় না, ওটা আনলিস্টেড। তবু কী করে যে লোকে জানতে পেরেছে কে জানে!
রণিতা বলে, মনে হয় আমি যেভাবে জেনেছি সেইভাবেই—
আরে তাই তো। তোমার কে এক আত্মীয়ের কথা বলছিলে না, টেলিফোনের বড় অফিসার। কিরকম আত্মীয় হন?
সম্পর্কে দাদা হন।
এইরকম সব সোর্স থেকেই জানাজানি হয়েছে। তবে আমি ধরা দিই না। পরিষ্কার বলি নয়নতারা নামে এ বাড়িতে কেউ থাকে না।