বুদ্ধিমতীটাই পছন্দ তোমার?
অল্প হেসে মাথা হেলিয়ে দেয় রণিতা।
নয়নতারা সোজা তার চোখের দিকে তাকিয়ে এবার বলেন, কিন্তু তুমি যেভাবে আমাদের বাড়িতে ঢুকেছ তাতে বুদ্ধির পরিচয় নেই। যা রয়েছে তা হল ঝুঁকি, মারাত্মক ধরনের রিস্ক। এভাবে পর পর পাঁচদিন ঢোকাটা ঠিক হয় নি।
রণিতা হকচকিয়ে যায়, কিভাবে ঢুকেছি?
নয়নতারা হঠাৎ উঠে দাঁড়ান। কয়েক পা গিয়ে পুব দিকের একটা জানালা খুলে দিয়ে আঙুল বাড়িয়ে বলেন, ঐ দেখ–
রণিতার চোখে পড়ে জামগাছের ডাল থেকে নাইলনের সেই দড়িটা আংটাসুদ্ধ এখনও ঝুলছে। কাল ভোরে এপারে নামার পর ওটা খুলে নিতে ভুলে গিয়েছিল। কিন্তু নয়নতারা যে ওটা লক্ষ করবেন, কে ভাবতে পেরেছে! রণিতার মুখে বোকাটে নাভাস একটু হাসি ফোটে। পাঁচদিনের কথা বলেছেন নয়নতারা। তার মানে ওঁর চোখকে একদিনও ফাঁকি দিতে পারে নি সে।
জানালাটা বন্ধ করে নয়নতারা ফিরে আসেন। বসতে বসতে বলেন, কাল ঠিক কটায় এ বাড়িতে ঢুকেছ?
রণিতা তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকতে পারছিল না। মুখ নামিয়ে বলে, ভোর চারটেয়–
নয়নতারা বলেন, তার মানে তখনও বেশ অন্ধকার ছিল।
ছিল।
অন্ধকারে পড়ে গিয়ে হাত-পা ভাঙার যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল, না কী বল?
না।
একটু অবাকই হন নয়নতারা, না!
বিন্দুবাসিনীকে যা বলেছিল, নয়নতারাকেও তা-ই বলে রণিতা। অর্থাৎ মাউন্টেনিয়ারিং-এ ট্রেনিং নেবার ফলে নিজেকে বাঁচিয়ে উঁচুতে ওঠার বা নিচে নামার কায়দাটা সে ভালই রপ্ত করেছে।
নয়নতারা ধীরে ধীরে মাথা দুলিয়ে বলেন, আই সি, আই সি। আর কত বাড়িতে এভাবে ঢুকেছ?
আর কোথাও চুকিনি। আপনার বাড়িতেই প্রথম এবং খুব সম্ভব আপনার বাড়িতেই শেষ।
এবার সেকেন্ড ঝুঁকিটার কথা বলি।
রণিতা মুখ তুলে উগ্রীব তাকিয়ে থাকে।
নয়নতারার চোখেমুখে হঠাৎ কঠোরতা ফুটে বেরোয়, কিছুটা রূঢ় গলায় বলেন, ট্রেসপাসিংয়ের জন্যে আমি তোমাকে পুলিশের হাতে এখনই তুলে দিতে পারি জানো?
রণিতা কিন্তু ভয় পায় না। তার ভেতরকার সাহসী, ঝকঝকে, সপ্রতিভ তরুণীটি সক্রিয় হয়ে ওঠে। বলে, পারেন কিন্তু তা করবেন না।
নয়নতারার ফর্সা মসৃণ কপাল সামান্য কুঁচকে যায়। জিজ্ঞেস করেন, কী বলতে চাইছ?
পুলিশকে খবর দিলে তক্ষুনি সারা দেশ জেনে যাবে নয়নতারা দেবী কোথায় আছেন।
নয়নতারা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেন না, ঠোঁট টিপে চোখ বুজে কিছু ভাবতে থাকেন। নিঃশব্দে তাঁর প্রতিক্রিয়া লক্ষ করে যায় রণিতা।
একসময় চোখ মেলে নয়নতারা বলেন, পুলিশকে ফোন না করলেও সে ভয়টা তো এখনও আছে।
রণিতা জানতে চায়, কিরকম?
তুমি আমাকে খুঁজে বার করেছ, তুমিই তো ঢাক ঢোল পিটিয়ে সারা পৃথিবীকে সেটা জানিয়ে দিতে পার।
নো নো নেভার। আমি আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছি, আপনার পারমিসান না পাওয়া পর্যন্ত কাউকে কিছু বলব না। আপনার শান্তি নষ্ট হয়, আপনি অসন্তুষ্ট হন, এমন কাজ কি করতে পারি?
নয়নতারার মুখ এবার কোমল দেখায়, যেন বেশ আশ্বস্ত হয়েছেন এমনভাবে বলেন, ওয়ার্ড অফ অনার?
ওয়ার্ড অফ অনার। রণিতা বলে, আপনি আমাকে আজ প্রথম দেখলেন, তবু বলছি আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন।
করলাম। নয়নতারা হাসলেন। একটু চুপ করে থেকে হঠাৎ সামনের দিকে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করেন, তুমি একলা বার্লিন ওয়াল ডিভেলে যে? সেই ছোকরা কোথায়?
রণিতা চকিত হয়ে ওঠে, কার কথা বলছেন?
ঐ যে পাশের বাড়ির ব্যালকনিতে বসে বিন্দুবাসিনী দেবী, তুমি আর যে যুবা পুরুষটি সকাল-সন্ধে চোখে দূরবীন লাগিয়ে ষড়যন্ত্র করতে আমি তার কথা বলছি। মজাদার হাসিটা দ্রুত রং পালটে ফিচেল হয়ে নয়নতারার সারা মুখে। ছড়িয়ে পড়ে।
চোখেমুখে যার কথার খই ফোটে সেই রণিতা দুবার আপনি-আপনি করে থেমে যায়।
নয়নতারা আরো ঝুঁকে আসেন, আমি কী?
আপনি আমাদের লক্ষ করেছেন?
বা রে, তোমরাই শুধু আমার ওপর নজর রাখবে আর আমি চুপ করে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকব, তাই কখনও হয়? একটু ওয়েট কর।
নয়নতারা আরেক বার উঠে পড়েন, ডান পাশের একটা ঘর থেকে একটা বাইনোকুলার হাতে ঝুলিয়ে ফিরে এসে বলেন, তোমাদের মতো আমারও একটা পাওয়ারফুল দূরবীন আছে। এটা দিয়ে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে আমিও কিছুটা যোগাযোগ রাখতে চেষ্টা করি।
চুরি ধরা পড়ার পর মানুষের যা হয়, রণিতার হাল অনেকটা সেইরকম। কারো বাড়ির ওপর নজরদারি করার সন্তোষজনক এবং বিশ্বাসযোগ্য কী কৈফিয়ত তৈরি করা যায়, মনে মনে সে যখন ভাবছে সেই সময় ফোন বেজে ওঠে।
হল-ঘরে সোফার পাশে একটা নিচু স্ট্যান্ডে যে টেলিফোন রয়েছে, আগে লক্ষ করেনি রণিতা। নয়নতারা ফোনটা তুলে নিয়ে খাঁটি ঢাকাইয়া উচ্চারণে গেঁয়ো মেয়েদের মতো কথোপকথন চালিয়ে যান।
ওধারের কথা কিছুই শোনা যাচ্ছে না। নয়নতারা বলছেন, কারে চাইতে আছেন?… নাই, বাড়িতে নাই… মেমসাব কহন (কখন) বাইর হন, কহন ফিরেন তেনিই জানেন.. আর জানেন মা কালী… আইজ্ঞা.. যহন ইচ্ছা ফোন কইরেন… পাইবেন না তেনারে…আইজ্ঞা তেনার নাম?… নয়নতারা বইলা কারোরে চিনি ..যিনি আছেন তেনারেই চাই?… আইচ্ছা যহন ইচ্ছা ফোন কইরেন… পাইবেন না তেনারে.. কুনোদিনই পাইবেন না… পন্নাম (প্রণাম)। রাখি…
প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, সফিস্টিকেটেড, গ্ল্যামারাস নয়নতারা যে এত দ্রুত একটি গ্রাম্য মেয়ের ভূমিকায় নেমে আসতে পারেন, কে ভাবতে পেরেছিল। চমৎকৃত, মুগ্ধ রণিতা তাকিয়ে তাকিয়ে নয়নতারাকে দেখছিল। তিনি ফোনটা নামিয়ে রাখতেই সে বলে ওঠে, আপনার ঐ গলার স্বর আর লাংগুয়েজ আমার খুব চেনা।