দারোয়ান বলে, বৈঠিয়ে দিদিজি। মেমসাব আববি ইহা আ যায়েঙ্গি।
সে আর দাঁড়ায় না, সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে নিচে নেমে যায়।
কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে রণিতা। তারপর ব্যাগটা কাঁধ থেকে কার্পেটে নামিয়ে আস্তে আস্তে একটা সোফায় বসে পড়ে। তার মতো সাহসী, অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয় মেয়ের কেমন যেন নার্ভাস লাগছে।
মিনিট দশেকও কাটল না, দক্ষিণ দিকের একটা বেডরুমের পর্দা সরিয়ে হল-এ এসে দাঁড়ালেন নয়নতারা। প্রথমটা রণিতার মনে হল বিভ্রম, এই সকালবেলায় সে যেন অলীক কোনো স্বপ্ন দেখছে। মায়াকাননের যে পরী পঁয়ত্রিশটি বছর সারা দেশকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন, তিনি এখন তার মাত্র দশ ফুট দূরে– ভাবা যায়!
কে বলবে ষাট পেরিয়েছেন নয়নতারা। সময়ের মেকআপম্যান কপালের দিকের চুলে হালকা সাদা রং মাখিয়ে দেওয়া ছাড়া আর প্রায় কিছুই করে নি, লক্ষ করলে মুখের মসৃণ ত্বকে মিহি সুতোর মতো দু-চারটে সরু দাগ হয়তো খুঁজে বার করা যাবে। ব্যস, ঐ পর্যন্ত।
নয়নতারার পরনে এই মুহূর্তে গোলাপি সিল্কের শাড়ি এবং ঐ রঙেরই হাতায় সুতোর কাজ-করা জামা, পায়ে ফোমের হালকা স্লিপার।
সবে আশ্বিনের শুরু। গোটা হল-ঘরটায় দরজা-জানলা দিয়ে অজস্র মায়াবী আলো এসে পড়েছে। নয়নতারা আসায় সেই আলোর দ্যুতি যেন হঠাৎ কয়েক গুণ বেড়ে গেছে।
মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিল রণিতা। নয়নতারা তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন। এই হাসিটির মধ্যে এমন এক পরমাশ্চর্য জাদু মেশানো যা তিনটি দশক ভারতীয় সিনেমা আর স্টেজকে রমণীয় লাবণ্যে ভরে দিয়েছে।
নয়নতারা সোফা দেখিয়ে বলেন, বসো।
রণিতা যেন ঘরের ভেতর থেকে উঠে এল। বলে, আপনি আগে বসুন–
ঠিক আছে।
দুজনে মুখোমুখি বসে।
নয়নতারা বলেন, তোমার নামটা জানলে কথা বলতে সুবিধে হবে। পরক্ষণে কিছু মনে পড়তে সামান্য অপ্রস্তুত হলেন যেন, ঐ যাঃ, তোমাকে তুমি করে বলছি কিন্তু।
রণিতা টের পাচ্ছিল তার বুকের ভেতর তীব্র নিখাদে কোনো অপার্থিব অর্কেস্ট্রা বেজে যাচ্ছে। সে ব্যস্তভাবে বলে ওঠে, তুমি করে না বললে আমার অস্বস্তি হবে। তারপর নিজের নাম বলে।
নয়নতারা বলেন, ফাইন। এবার বল তো তুমি চতুর না বুদ্ধিমতী?
ভেতরে ভেতরে থমকে যায় রণিতা। নয়নতারার কথাটার একটা চাপা ইঙ্গিত আছে। সে সতর্কভাবে বলে, মানে–
উত্তর না দিয়ে নয়নতারা বলেন, তার আগে এক কাজ কর, সোজা বাথরুমে চলে যাও। মুখটুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে এস, তারপর কথা হবে। বাথরুমে নতুন পেস্ট, ব্রাশ, টাওয়েল, সব রয়েছে। বলে ডান দিকের পদা-ঢাকা দরজা দেখিয়ে দেন।
রণিতা বিমূঢ়ের মতো তাকিয়েই থাকে। তার যে সকালে টয়লেটে যাওয়া হয়নি, গাছে হেলান দিয়ে বাগানে রাতের শেষ দিকটা কেটেছে, নয়নতারা জানলেন কী করে? কিন্তু বসে থাকা সম্ভব হয় না, নয়নতারা তাকে তাড়া দিয়ে বাথরুমে পাঠিয়ে দেন।
প্রায় আড়াইশ স্কোয়ার ফিটের বাথরুমটা ধবধবে বাথটাব, কমোড, শাওয়ার, ওয়াল-মিরর ইত্যাদি দিয়ে চমৎকার সাজানো। একধারে সুদৃশ্য ক্যাবিনেটে নতুন ভোয়ালে, ব্রাশ পেস্টও রয়েছে।
ভোরের দিকের ঘণ্টা দেড়েক বাদ দিলে কাল সারা রাত গেল পাঁচদিনের মতো একেবারেই ঘুম হয়নি। নয়নতারাকে দেখার পর একটা ঘোরের মধ্যে ছিল রণিতা। এখন বোঝা যাচ্ছে, চোখ জ্বালা জ্বালা করছে, কপালের দুধারে শিরাগুলো সমানে লাফাচ্ছে। অনেকক্ষণ চোখে মুখে ঠাণ্ডা জলের ঝাঁপটা দিয়ে দাঁত ব্রাশ ট্রাশ করে যখন সে বেরিয়ে এল নিজেকে বেশ টাটকা লাগছে। চোখের জ্বালা এবং কপালের দপদপানিটা আর নেই।
নয়নতারা একই জায়গায় বসে ছিলেন। হাসিমুখে বলেন, এস।
রণিতা গিয়ে তার সোফাটায় বসতে না বসতেই একটি বয়স্কা কাজের মেয়ে চাকাওলা ট্রলিতে ব্রেকফাস্ট সাজিয়ে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে এল। সেন্টার টেবলে ফল, কণফ্লেকস, দুধ, টোস্ট, মাখন, সুগার কিউব, জেলি, অমলেট, টি-পট, মিল্কপট, খালি কাপপ্লেট নামিয়ে রেখে ট্রলি নিয়ে হল-ঘর থেকে সে নিঃশব্দে অদৃশ্য হয়ে গেল। একেই বিন্দুবাসিনীদের ব্যালকনি থেকে দু-একবার দেখেছে রণিতা। অনুমান করা যায়, সে যখন টয়লেটে সেই সময় নয়নতারা কাজের মেয়েটিকে ব্রেকফাস্টের কথা বলে দিয়েছিলেন।
নয়নতারা বলেন, শুরু কর।
এমন রাজকীয় অভ্যর্থনা পাবে, ভাবে নি রণিতা। কুণ্ঠিতভাবে বলে, কিন্তু–
তোমার মতো স্মার্ট মেয়ের কাছে এমনসঙ্কোচ আশা করি নি।প্লিজ স্টার্ট–
রণিতা লক্ষ করল, একজনের মতো খাদ্যবস্তু আনা হয়েছে। সে জিজ্ঞেস করে, আপনার ব্রেকফাস্ট?
নয়নতারা বলেন, দুকাপ বেড টি ছাড়া সকালে আমি আর কিছু খাই না। সাড়ে পাঁচটায় আমার চা খাওয়া হয়ে গেছে।
রণিতা আর কোনো প্রশ্ন করে না। তার ব্রেকফাস্ট শেষ হলে নয়নতারা টি-পট থেকে একটা কাপে সোনালি লিকার ঢেলে তাতে দুধ মিশিয়ে জিজ্ঞেস করেন, কটা সুগার কিউব দেব?
নয়নতারা নিজের হাতে তাকে চা করে খাওয়াবেন, এটা ছিল অকল্পনীয়। অভিভূতের মতো রণিতা বসে থাকে। বলে, একটা–
চামচে করে সুগার কিউব তুলে চায়ে মিশিয়ে রণিতাকে কাপটা দিতে দিতে নয়নতারা বলেন, এবার আমার সেই প্রশ্নটার উত্তর দাও।
সঙ্গে সঙ্গে কিছু বলে না রণিতা। চায়ে একটা হালকা চুমুক দিয়ে আস্তে আস্তে শুরু করে, চতুর শব্দটা ভাল না।