দারোয়ান এবার ডাকে, এ মেমসাব– এবার তার কণ্ঠস্বর রীতিমত রুক্ষ।
রণিতা গম্ভীর মুখে বলে, কী বলছ?
আপলোগ চুরায়া ইয়ে কোটিমে গুসা! চলিয়ে চলিয়ে—
কাঁহা।
কোটিকা বাহার–
রণিতা তাকে বোঝাতে চেষ্টা করে, কোনো বদ মতলব নিয়ে সে এখানে আসে নি, শুধু নয়নতারার সঙ্গে একবার দেখা করেই চলে যাবে কিন্তু তার কথায় কর্ণপাত করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই দারোয়ানটার। এক নাগাড়ে কর্কশ গলায় বলে যায়, চলিয়ে চলিয়ে প্রায় ঘাড় ধাক্কা দিতে দিতেই রণিতাকে বাড়ি থেকে বার করে দিয়ে গেট বন্ধ করে দেয় সে।
রণিতা যেমনই একরোখা তেমনি প্রচণ্ড তার ধৈর্য। একটা কিছু মাথায় চাপলে তার শেষ না দেখে ছাড়ে না। কাজেই পরদিন রাতেও ফের কালো জামগাছের ডালে আংটা আটকে চোদ্দ নম্বর বাড়িতে ঢুকে পড়ে এবং পরদিন সকালে দারোয়ান আবার তাকে বাইরে বার করে দেয়।
পর পর চারদিন একই ব্যাপার ঘটে যায়। তবু হাল ছাড়ে না রণিতা। পঞ্চম দিন সকালে দারোয়ানের আচরণ পুরোপরি বদলে যায়। সে ডাকে, এ দিদিজি—দিদিজি–
মেমসাব থেকে দিদিজি। রণিতা বেশ অবাকই হয়। তার মনে হয়েছিল দারোয়ানটা অন্যদিনের মতোই তাকে বাড়ি থেকে বার করে দেবে। তা নয়, রীতিমত মোলায়েম সুরেই ডাকাডাকি করছে। এটা কোনো চতুর চাল কিনা বোঝা যাচ্ছে না। সতর্ক ভঙ্গিতে রণিতা বলে, কী বলছ?
আপ আইয়ে মেরা সাত (সাথ)।
কোথায়?
দারোয়ান বলে, কোটিমে–তার হিন্দি উচ্চারণটা বাচ্চাদের মত আধো আধো, নেপালি বা ভুটিয়ারা যেভাবে বলে থাকে অবিকল সেই রকম।
শিরদাঁড়া পলকে টান টান হয়ে যায় রণিতার। কিসের একটা সংকেত সে পেয়েছে আবছাভাবে। দারোয়ানটিকে বাজিয়ে নেবার জন্য বলে, বাড়ির ভেতর যাবার কথা বলছ?
জি।
কিন্তু—
গাবড়াইয়ে মাত। মেমসাব নিয়ে যেতে বলেছেন–
ফুসফুসের ভেতর দিয়ে চকিতে বিদ্যুৎ প্রবাহ খেলে যায়। দারোয়ানটা কার কথা বলছে, বুঝতে পেরেও রণিতা জিজ্ঞেস করে, কোন মেমসাহেব?
সোজাসুজি উত্তর না দিয়ে দারোয়ান ভাবলেশহীন মুখে জানায়, রণিতা তার সঙ্গে গেলেই প্রশ্নের উত্তরটা পেয়ে যাবে।
রণিতা আর কিছু বলে না, ব্যাগটা কাঁধে ফেলে কোনো স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে একবার পেছন ফিরে তাকায়। বারো নম্বর বাড়ির পশ্চিমের ব্যালকনিতে দেখা যাচ্ছে বিন্দুবাসিনীকে। ভোর রাতে চারটে থেকে আগের পাঁচদিনের মতোই ঐ একই জায়গায় একই ভঙ্গিতে, পিঠ সোজা করে অনড় মূর্তির মতো নিচু দড়ির চেয়ারে বসে আছেন তিনি। আটাশ বছরের সতেজ দৃষ্টি দিয়েও এতদূর থেকে তাঁর মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না, তবে সেই মুখে যে প্রচণ্ড উৎকণ্ঠা মাখানো সেটা অনুমান করা যায়।
দারোয়ান আস্তে তাড়া লাগায়, চলিয়ে দিদিজি–
হাঁ চল–মুখ ফিরিয়ে দারোয়ানের পাশাপাশি রণিতা হাঁটতে শুরু করে। সে বুঝতে পারছিল নয়নতারা তাকে গাছে হেলান দিয়ে ঘুমোত দেখে দারোয়ানকে দিয়ে ডেকে পাঠিয়েছেন কিংবা দারোয়ানটাই তাকে দেখে নয়নতারাকে আজ খবর দিয়ে থাকতে পারে। যিনি দীর্ঘ আট বছর আত্মগোপন করে আছেন, কোনোভাবেই বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চান না, তাঁর পক্ষে এভাবে ডাকিয়ে নিয়ে যাওয়াটা প্রায় অভাবনীয়। দারোয়ানের ঘাড় ধাক্কা খাওয়াটা এই কদিনে গা-সওয়া হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ বাড়ির ভেতর ডাক পড়ায় দস্তুরমতো অবাকই হয় রণিতা। নয়নতারার উদ্দেশ্যটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তিনি কি স্বেচ্ছা নির্বাসন থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছেন?
বাগান পেরিয়ে যেতে যেতে রণিতা টের পায়, হৃৎপিণ্ডের উত্থান পতন দ্রুততর হয়ে উঠেছে, তার শব্দও যেন শুনতে পাচ্ছে সে। কয়েক মিনিটের ভেতর ভারতীয় স্টেজ এবং স্ক্রিনের এক সুপারস্টারের সঙ্গে, যাঁকে বলা হয় লিভিং লিজেন্ড, দেখা হতে যাচ্ছে। কিছুদিনের মধ্যে সারা দেশ জেনে যাবে নয়নতারাকে তাঁর রহস্যময় অজ্ঞাতবাস থেকে সে-ই বার করে এনেছে। তীব্র এক উত্তেজনা দ্রুত তার মধ্যে চারিয়ে যেতে থাকে।
বাগানের পর নুড়ির রাস্তা, তারপর চওড়া চওড়া আটটা স্টেপ ওপরে উঠে কারুকাজ-করা প্রকাণ্ড দরজার ভেতর দিয়ে দুজনে একটা বড় হল-ঘরে চলে আসে। হল-টা দামি লাল, কার্পেট ঢাকা, তার একধারে নানা আকারের পেতলের সুদৃশ্য টবে অশখ, মহুয়া, আম, কাঁঠাল, দেবদারু, ঝাউ ইত্যাদি নানা গাছের বনসাই। আরেক দিকে দেওয়ালের গা ঘেঁষে কোমরসমান হাইটের! ক্যাবিনেটের ওপর ব্রোঞ্জ, কাঁসা, পেতল, লোহা ইত্যাদি নানা ধাতুর আশ্চর্য সব ভাস্কর্য। এগুলোর কোনোটা নটরাজ, কোনোটা ওড়িষার কোনো মন্দিরের যক্ষী, কোনোটা আফ্রিকার বা উপজাতির নারীমূর্তি। মাঝখানে চার সেট সোফা।
হল-ঘরের এক পাশ দিয়ে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি, সিঁড়িগুলো আগাগোড়া জুটের ম্যাট দিয়ে মোড়া। দারোয়ান রণিতাকে সেদিকে নিয়ে গেল, বলল, উপর চলিয়ে–
গুনে গুনে তিরিশটা সিঁড়ি পেরিয়ে রণিতা দারোয়ানের পিছু পিছু দোতলায় উঠে আসে। একতলার মতো অবিকল একই রকমের আরেকটা হল, পেতলের টবে তেমনই সব বনসাই, তবে দুটো দেওয়ালের গায়ে কাঁচের পাল্লা-দেওয়া বুক কেসগুলিতে অজস্র বই। এক দেওয়ালে চার্লি চ্যাপলিন, গ্রেটা গার্বো আর সোফিয়া লোরেনের বড় ছবি। বোঝা যায়, এ বাড়ির স্বত্বাধিকারিণী ঐ তিন মহান শিল্পীর অনুরাগিণী। অন্য একটি দেওয়ালে রবীন্দ্রনাথের বিরাট অয়েল পেন্টিং। হল ঘরটাকে ঘিরে রয়েছে বেশ কটি বেডরুম, সেগুলোর দরজায় পেস্তা রঙের পর্দা ঝুলছে।