আঙুল বাড়িয়ে টেলিফোন স্ট্যান্ডটা দেখিয়ে দেন সুধাময়ী, পরক্ষণে মহাভারতের আড়ালে তাঁর মুখ অদৃশ্য হয়।
ঠিক বুঝতে না পেরে সুধাময়ীকে ফের ডাকতে যাবে রণিতা, হঠাৎ মুক্তা বলে ওঠে, ওখানে যাও ছোটদি, যা জানতে চাইছ ফোনের কাছে সব আছে।
অর্থাৎ এতক্ষণ নিচে বসে রণিতার কথাগুলো শুনেছে মুক্তা। সুধাময়ী তো মুখ ফুটে কিছু বলবেন না, তাঁর হয়ে উত্তরটা ওকেই দিতে হল।
রণিতা কিন্তু তক্ষুণি ফোনের কাছে যায় না, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাকে দেখতে থাকে। সুধাময়ী তার ওপর অনেকদিন ধরেই অসন্তুষ্ট হয়ে আছেন। তিনি পুরনো ধ্যান-ধারণার মানুষ। রণিতার চালচলন, পোশাক আশাক, কোনোটাই পছন্দ করেন না। বিশেষ করে সে যে ধরনের কাজকর্ম করে এবং সে জন্য সারা ভারতে টই টই করে ঘুরে বেড়ায়, এতে ঘোর আপত্তি সুধাময়ীর। এ ব্যাপারে স্বামীর ওপরেও তিনি প্রচণ্ড বিরক্ত। মেয়েদের সম্বন্ধে ইন্দ্রনাথ বড় বেশি লিবারেল, স্ত্রী-স্বাধীনতার তিনি একজন বিরাট পৃষ্ঠপোষক। তাঁরই আশকারায় তাঁদের এই হোট মেয়েটা একেবারে মাথায় চড়ে বসেছে।
আসলে সাতাশ পেরিয়ে আটাশ বছরে পড়েছে রণিতা। তার বিয়ের জন্য অস্থির হয়ে উঠেছেন সুধাময়ী। কদিন আগে রণিতার ছোট মামা একটা ছেলের খোঁজ এনেছিলেন। পাত্রটি চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট এবং এম বি এ, আপাতত একটা
বড় কোম্পানিতে একজিকিউটিভ, কয়েক মাসের ভেতর আমেরিকায় চলে যাবে। সেখানকার এক ফার্ম তাকে বিশাল অফার দিয়েছে। যাবার আগে মা-বাবা ছেলের বিয়ে দিতে চান। রণিতাকে ওঁরা দেখেছেন, পুত্রবধূ হিসেবে তাকে পেতে খুবই আগ্রহী। কিন্তু রণিতা রাজি হয় নি, হেসে হেসে এমন একটা চমৎকার সম্বন্ধ উড়িয়েই দিয়েছে, জানিয়েছে, কোথাও বাঁধা পড়ার সময় এখনও হয়নি। আগে কেরিয়ার, তারপর অন্য সব। কিন্তু কেউ জানে না, অমিতেশকে সে কথা দিয়ে রেখেছে, সেখান থেকে তার পক্ষে ফেরা আর সম্ভব নয়।
সেই থেকে সুধাময়ী অঘোষিত এক যুদ্ধই শুরু করে দিয়েছেন। রেগে গেলে তিনি চিৎকার টিকার করেন না, শুধু কথা বন্ধ করে দেন, তাতেও কাজ না হলে এক ফোঁটা জল পর্যন্ত খাবেন না। স্রেফ নির্জলা অনশন। এই নীরব অহিংস প্রতিবাদ এক ধরনের প্যাসিভ রেজিস্টান্স, নিজেকে কষ্ট দিয়ে অন্যের নার্ভে এই যে ক্রমাগত চাপ দেওয়া, এটাকে ভীষণ ভয় পায় রণিতা। একবার সে ভাবল মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, রাগ কোরো না মা। তুমি কথা না বললে আমার কত কষ্ট হয়, জানো না? কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই করল না সে, কিছুই বলল না, সোজা ফোনের কাছে চলে গেল।
ফোন-স্ট্যান্ডে পেপার ওয়েটের তলায় এক টুকরো কাগজ রয়েছে। ঢাউস ব্যাগটা কাঁধ থেকে মেঝেতে নামিয়ে সেটা তুলতেই কটা লাইন চোখে পড়ল। গোটা গোটা অক্ষরে মা লিখে রেখেছেন রজনী দুবার ফোন করেছিল। সে তাদের বাড়িতেই অপেক্ষা করবে। তুই ফেরামাত্র ফোন করতে বলেছে। লাইনগুলোর নিচে একটা ফোন নাম্বারও লেখা রয়েছে।
কোন রজনী প্রথমটা ধরতে পারল না রণিতা। বম্বেতে আছে রজনী যোশি আর দিল্লিতে রজনী শর্মা। সুধাময়ী লেখেননি, ফোনটা ঠিক কে করেছিল। তাঁকে জিজ্ঞেস করে জেনে নেবে কিনা ভাবতে গিয়ে ফোন নাম্বারটার দিকে আবার নজর গেল। আগে ভাল করে লক্ষ করেনি, এখন দেখা গেল ওটা দিল্লিরই নাম্বার। তার মানে রজনী শর্মা।
কয়েকটা বছর পুনের ফিল্ম ইনস্টিটিউটে দুই রজনী আর রণিতা একসঙ্গে কাটিয়েছে। ওখানকার কোর্স শেষ করার পর তিনজন এখন তিন শহরে। ওদের সঙ্গে অনেকদিন যোগাযোগ নেই রণিতার। হঠাৎ দিল্লির রজনী কেন ফোন করল, কে জানে।
রণিতা ডায়াল করে কয়েক সেকেন্ডের ভেতর রজনীকে ধরে ফেলল। কলকাতার লোকাল লাইন ধরতে জিভ বেরিয়ে যায় কিন্তু লং ডিসটাল লাইনে কোনরকম সমস্যা নেই। নেহাত এনগেজড না থাকলে দু-একবার ডায়াল করলেই পাওয়া যায়।
রণিতা বলে, হ্যালো রাজু, আমি রণি– রজনীর ডাক নাম রাজু।
রজনী বলে, হাই রণি, দুদুবার তোকে ফোন করেছিলাম। আন্টি বললেন, বেরিয়েছিস, কখন ফিরবি ঠিক নেই!
ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে গিয়েছিলাম, কিছু নোট নেবার দরকার ছিল। কেমন আছিস বল–
ফাইন। আমি কখনও খারাপ থাকি না। এভার চিয়ারফুল। তোর খবর কী?
রজনী খুবই টগবগে ছটফটে আমুদে ধরনের মেয়ে, দারুণ উচ্ছ্বাসপ্রবণ। সেটা তার কাছে আসামাত্র টের পাওয়া যায়। পুনেতে কটা বছর ইনস্টিটিউটের ক্যাম্পাসটাকে সে মাতিয়ে রেখেছিল।
রণিতা বলে, চলে যাচ্ছে। তারপর বল ফোন করেছিলি কেন? আসলে ফোনের কারণটা জানার জন্য প্রচণ্ড কৌতূহল হচ্ছিল তার।
মজার গলায় রজনী বলে, বোলুঙ্গি বাবা, বোলুঙ্গি। দুমিনিটের জন্যে ধৈর্য ধর! ওনলি টু মিনিটস। আগে বল বাড়ির কে কেমন আছেন?
ভাল।
তোর কাজটাজ কেমন চলছে?
নট ব্যাড়। দার্জিলিংয়ের টি গার্ডেনগুলোর ওপর চল্লিশ মিনিটের একটা ডকুমেন্টারি করলাম। শুটিং শেষ হয়েছে, এডিটিং চলছে। এরপর ভাবছি মধ্যপ্রদেশের মারিয়া ট্রাইবের ওপর একটা ছবি করব। তার জন্যে কিছু মেটিরিয়াল জোগাড় টোগাড় করছি।
ভেরি গুড।
তুই কী করছিস?
তিনটে বিগ কর্পোরেট হাউসের অ্যাড করছি। কম লেবার, অনেক টাকা। তুই যদি করতে চাস বল, অ্যাড-এর কাজ পাইয়ে দিতে পারি।
এখন ইচ্ছে নেই। পরে যদি ভাবি তোকে জানাব।