রণিতার বন্ধুরা যখনই আসে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। বলে, দারুণ! তোদের বাড়িতে এলে অ্যারিস্টোক্র্যাসি ব্যাপারটা ফিল করা যায়। তারা কতটা অভিজাত, রণিতা কোনো দিন ভেবে দেখেনি। তবে শতাব্দী যখন শেষ হয়ে আসছে, চারপাশের বনেদি বাড়িগুলো ভেঙে তোলা হচ্ছে বাক্স প্যাটার্নের বিশাল বিশাল হাই-রাইজ, কলকাতা মেট্রোপলিসের মানুষ আটশ কি হাজার স্কোয়ার ফিটের অ্যাপার্টমেন্টে নিজেদের বন্দি করে ফেলছে ক্রমাগত, তখন পঞ্চাশ বছর আগের খোলামেলা পুরনো গন্ধওলা আবহাওয়ায় থাকতে ভালই লাগে রণিতার।
চারপাশে আলো জুলছিল। প্যাসেজ ধরে কপা এগুলেই দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। তার দুধারে পেতলের চকচকে পাত-বসানো কাঠের রেলিং।
সিঁড়িতে সবে পা রেখেছে রণিতা, অনাথ দরজা বন্ধ করে প্রায় দৌড়েই কাছে চলে আসে। একটু অবাক হয়ে রণিতা জিজ্ঞেস করে, কিছু বলবে?
ব্যস্তভাবে অনাথ বলে, হ্যাঁ। কে একজন দিল্লি না বোম্বাই থিকে তোমারে দুবার ফোন করেছিল। খুব নাকিন জরুরি।
রোজ অনেক ফোন আসে রণিতার কিন্তু দিল্লি বা বম্বে থেকে কে করতে পারে? ওই দুই শহরে তার বেশ কয়েকজন বন্ধু আছে, তাদেরই কি কেউ? দুবার যখন করেছে, নিশ্চয়ই ব্যাপারটা আর্জেন্ট। সে জিজ্ঞেস করে, কে ফোন করেছে, জানো?
অনাথ বলে, আমিই ফোনটা ধরেছিলাম গ ছোটদিদি। ইংরিজি আর হিন্দি মিন্দিতে কী কইতে লাগল। বুজতে না পেরে মাকে দিলাম। মা সব জানেন। রণিতার মাকে সে মা বলে।
ঠিক আছে।
একসঙ্গে দুটো করে স্টেপ পেরিয়ে পেরিয়ে পলকে দোতলায় উঠে আসে রণিত। এখানে প্রকাণ্ড একটা হল-কে ঘিরে পাঁচটা বেডরুম, প্রতিটি ঘরের সঙ্গে অ্যাটাচড বাথ। বেড-রুমগুলোর একটা রণিতার, একটা তার মা-বাবার, একটা দাদার, একটায় বাবার লাইব্রেরি, বাকিটা খালি পড়ে থাকে। দিদি-জামাইবাবু বা অন্য কোনো ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধব এলে ওখানে থাকে।
হল-ঘরের তিন কোণে তিন সেট সোফা আর সেন্টার টেবল। একসঙ্গে রণিতা, তার দাদা বা বাবার কাছে ভিজিটররা এলে যাতে কোনো অসুবিধা না হয় সেই জন্য এই ব্যবস্থা। অবশ্য একতলায় একটা ড্রইং রুম আছে, কিন্তু সেটা বন্ধই থাকে। কেউ এলে পারতপক্ষে রণিতারা নিচে নামতে চায় না, অগত্যা ভিজিটরদের সঙ্গে করে অনাথ ওপরে নিয়ে আসে।
হল-এর মাঝখানে রঙিন টিভি, পিয়ানো, ভি সি আর, টেলিফোন এবং অজস্র ক্যাসেট নানা সুদৃশ্য ক্যাবিনেটে চমৎকার সাজিয়ে রাখা হয়েছে। চার দেওয়ালে ল্যাম্পশেডের ভেতর আলো জ্বলছে এখন, সিলিং থেকে বিরাট একটা ঝাড়লণ্ঠন ঝুলছে, তার আলো অবশ্য জ্বালানো হয়নি।
বাড়িটা এখন প্রায় ফাঁকাই। রণিতার দাদা পূর্ণেন্দু অয়েল ইণ্ডিয়ার ইঞ্জিনিয়ার, মাস দুই হল কলকাতা থেকে তাকে বরোদায় বদলি করা হয়েছে, বৌদি বন্দনাও তার সঙ্গে গেছে। বাবা অর্থাৎ ইন্দ্রনাথ ইউনিভার্সিটি থেকে রিটায়ারমেন্টের পর দুপুরের পর বেশির ভাগ দিনই বাড়িতে থাকেন না; মিটিং সেমিনার, এসব নিয়েই আছেন। আজও তিনি যথারীতি বাড়ি নেই।
রণিতা লক্ষ করল, দক্ষিণ দিকের দেওয়াল ঘেঁষে একটা গদি-মোড়া ইজিচেয়ারে আধশোয়া ভঙ্গিতে খুব মগ্ন হয়ে বই পড়ছেন সুধাময়ী। তাঁর বয়স যাটের কাছাকাছি। এমন তুলতুলে, নরম মানুষ চিৎ চোখে পড়ে। এখনও প্রচুর ঘন চুল তাঁর, সময় অবশ্য অদৃশ্য ব্রাশ টেনে তার রং অনেকটাই বদলে দিয়েছে। কালো চুলের ফাঁকে ফাঁকে অসংখ্য রুপোর তার। এই বয়সেও সুধাময়ীর মুখখানায় অপার্থিব সারল্য মাখান, নিষ্পাপ কিশোরীর মুখে যেমনটি থাকে। পরনে লাল পাড় গরদের শাড়ি, গরদেরই ব্লাউজ। কপালে মস্ত সিঁদুরের ফোঁটা। সব মিলিয়ে তাঁকে ঘিরে যেন আশ্চর্য এক দেবমহিমা।
রণিতা জানেসুধাময়ী কী বই পড়ছেন। রাজশেখর বসু কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসের মূল মহাভারতের ডালপালা হেঁটে একটা তরতরে চেহারা দিয়েছেন, ইদানীং মনের দিক থেকে সেটাই তাঁর স্টেপল ফুড। এছাড়া মাঝে মাঝে রামকৃষ্ণ মিশন, বেলুড়মঠ বা দক্ষিণেশ্বরে যাওয়া তো আছেই। আজকাল এই নিয়েই তাঁর নিজস্ব জগৎ।
ইজিচেয়ারের ডান পাশের মেঝেতে বসে কুচি সুপুরি, লবঙ্গ, এলাচ, চুন, খয়ের আর দু-এক টুকরো সুগন্ধি জর্দা দিয়ে ছোট ছোট পানের খিলি তৈরি করছে মুক্তা। সুধাময়ীর খুব পান-জর্দার নেশা, দিনে কম করে তিরিশ চল্লিশ খিলি পান খান। তার যাবতীয় ব্যবস্থা করতে হয় মুক্তাকে। তার বয়স পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ. মোটামুটি সুশ্রী, বাপ-মা নেই। অল্প বয়সে বিধবা হবার পর ভাইরা দায়িত্ব নিতে চায়নি, নানা জায়গায় ভাসতে ভাসতে শেষ পর্যন্ত এ বাড়িতে এসে ঠেকেছে। বছর তেরো এখানে আছে, তাকে রণিতাদের বাড়ির একজন পার্মানেন্ট মেম্বারই বলা যায়।
সুধাময়ী তো ছেলেমেয়ে বা স্বামীকে বিশেষ কাছে পান না, যে যার নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। একমাত্র মুক্তাই তাঁকে সঙ্গ দেয়। সে তাঁর সর্বক্ষণের সহচরী এবং পার্সোনাল অ্যাসিসট্যান্ট।
কোনাচেভাবে পায়ে পায়ে সুধাময়ীর কাছে গিয়ে দাঁড়ায় রণিতা। একটু অস্বস্তি হয় তার, কেননা সাতদিন সুধাময়ীর সঙ্গে তার কথা বন্ধ। শেষ পর্যন্ত ডাকতেই হয়, মা
মহাভারতের পাশ দিয়ে মেয়ের দিকে তাকান সুধাময়ী কিন্তু কিছুই বলেন । রণিতা জিজ্ঞেস করে, আমাকে কে ফোন করেছিল?