প্রথম সত্তর আশিটা ফিল্মে নয়নতারা ছিলেন মামার কুইন। দেখা গেছে সেই সময়ের কোনো কোনো প্রতিবেদক তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন সেক্স বম্ব। কিন্তু সত্তরটার মতো ছবি হয়ে যাবার পর তাঁর অভিনয়ের স্টাইল আগাগোড়া পালটে যায়। বদলে যায় তাঁর ইমেজ। আর মামার বা সেল নয়। তাঁর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেন এমন এক শিল্পী যিনি বহুবর্ণময় জীবনকে নানা দিক থেকে ছুঁতে চান। এই সময় তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন আর অর্থহীন, অসার রোমান্টিক রোলে নামবেন না। এখন থেকে তাঁর ভূমিকাগুলি এই রকম। কখনও অধ্যাপিকা, কখনও প্রতিবাদী গৃহবধু, কখনও ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট, কখনও ফায়ারব্র্যান্ড রাজনৈতিক নেত্রী, কখনও বহুজনের হিতে নিবেদিত মিশনারি নান বা সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্ট। নয়নতারার নতুন ইমেজ সারা দেশকে চমকে দিল।
গ্ল্যামার কুইন হিসেবে তিনি মানুষকে মাতিয়ে দিয়েছিলেন। এবার যা পেলেন তা হল মর্যাদা আর শ্রদ্ধা। তাঁর প্রতি আকর্ষণ কিন্তু এতটুকু কমল না, পুরনো জনপ্রিয়তা অটুট থেকে গেল।
ফিল্ম কেরিয়ারের মাঝামাঝি সময়ে মঞ্চে যোগ দেন নয়নতারা। মোট একুশটি নাটকে অভিনয় করেছেন। এর কোনোটাই প্যানপেনে, স্যাঁতসেতে, আবেগসর্বস্ব নয়। বেশির ভাগেরই বিষয় নানা সামাজিক সমস্যা, মূল্যবোধের ক্ষয় বা অস্তিত্বের সঙ্কট। নাটকগুলি, বিশেষ করে নয়নতারার অভিনয় দর্শককে অভিভূত করে ফেলল। একেকটি নাটক মঞ্চস্থ হয়, আর নতুন করে দেশ যেন তাঁকে আবিষ্কার করে।
এত জনপ্রিয়তা, মানুষের এত শ্রদ্ধাই শুধু নয়, এর পাশাপাশি তাঁকে ঘিরে রয়েছে অজস্র স্ক্যান্ডাল। রঙিন ট্যাবলয়েড আর ফিল্ম ম্যাগাজিন এবং খবরের কাগজ থেকে এ ব্যাপারে যেটুকু পাওয়া গেছে তা এইরকম। একজন বিখ্যাত রাজনৈতিক নেতার কেরিয়ার তাঁর জন্যই নাকি শেষ হয়ে যায়। ভদ্রলোকের নাম রমাপতি সরখেল। সত্তরের দশকে নয়নতারাকে পাবার জন্য খেপে উঠেছিলেন, উন্মাদের মতো তিনি ওঁর পেছন পেছন সারাদিন ঘুরতেন। এই নিয়ে আবহাওয়া তখন সরগরম, আঁশটে গন্ধের মতো বাতাসে গুজব আর কুচ্ছো উড়ে বেড়াচ্ছে। খবরের কাগজে বোজ দুজনকে নিয়ে মদের চাটের মতো রগরগে মশলাদার স্টোরি বেরুচ্ছে। এতে রমাপতির দলের সুনাম নষ্ট হতে থাকে। উদ্বিগ্ন, ক্রুদ্ধ পাটি লিডারশিপ প্রথমে তাঁকে সাসপেন্ড করে, পরে অনেক ধরাধরির পর সাধারণ মেম্বার হয়েই রমাপতিকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। রাজনৈতিক দিক থেকে যাঁর আকাশ ছোঁয়ার কথা, তিনি কোথায় হারিয়ে গেছেন কে জানে। যদি এখনও বেঁচে থাকেন, তাঁর হাল পোড়া তুবড়ির খোলের মতো। কেউ তাঁর খবর রাখে না।
নয়নতারার জন্য সেই আমলের একজন ডিরেক্টর বিষ খেয়ে মরেছেন। আরেক জন গলায় দড়ি দিয়েছিলেন, স্ত্রী ঠিক সময়ে দেখে ফেলায় আত্মহত্যাটা আর শেষ পর্যন্ত করে উঠতে পারেননি। দুজন বিখ্যাত হিরো নাইনটি সেঞ্চুরির নাইটদের কায়দায় পিস্তল নিয়ে ডুয়েল লড়েছিলেন, খুনখারাপি অবশ্য হয়নি। তবে একজনের ট্রাউজার হাঁটু পর্যন্ত তুললে এক টাকা সাইজের একটা শুকনো কালো দাগ চোখে পড়বে, গুলিটা তাঁর পায়ের মাংস ভেদ করে বেরিয়ে গিয়েছিল। নয়নতারাকে নিয়ে এরকম আরো কত যে ঘটনা তার হিসেব নেই।
নয়নতারা বিবাহিত। কিন্তু যাঁকে ঘিরে এত স্ক্যান্ডাল তাঁর দাম্পত্য জীবন কখনও সুখের হয় না। খবরের কাগজে তাঁর স্বামী বা শ্বশুরবাড়ি সম্বন্ধে বিশেষ কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এটুকুই শুধু জানা গেছে, ষাটের দশকের মাঝামাঝি স্বামীর সঙ্গে নয়নতারার সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়, গলফ ক্লাবের কাছাকাছি একটা বাড়িতে তিনি একলা থাকতে শুরু করেন। তবে কোর্ট থেকে বিবাহ বিচ্ছেদটা হয়েছিল কিনা তার হদিস মেলেনি। এই বাড়ি থেকেই উনিশ শ ছিয়াশিতে তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে যান।
নয়নতারা আলৌকিক কোনো দেবী নন, ভাল-মন্দ পাপ-পুণ্য স্তুতি-কুৎসার মিশ্রণে রক্তমাংসের উষ্ণ, পরিপূর্ণ এক মানুষী। খবরের কাগজের হলদে হয়ে আসা শুষ্ক পুরনো পাতা আর তাঁর অভিনীত ফিল্মগুলি থেকে কতটুকুই বা তাঁকে পাওয়া যাবে! ডকু-ফিচারটায় জীবনের উত্তাপ, উত্তেজনা আর গাঢ় আবেগ চারিয়ে দতে হলে নয়নতারাকে চাইই চাই।
লাইব্রেরিতে কাগজপত্রের স্কুপের ভেতর মুখ ডুবিয়ে রণিতা যেমন নোট নয়েছে সেই সময় ফিল্ম স্টুডিওগুলোতে গিয়ে নয়নতারার খোঁজ করেছে অমিতেশ কিন্তু কেউ তাঁর সন্ধান দিতে পারেনি।
শেষ পর্যন্ত ওরা ঠিক করেছে, প্রথমে যাবে পুলিশের মিসিং পার্সনস ডিপার্টমেন্টে। ওদের কাছে নিখোঁজ মানুষজনের অনেক খবর থাকে। তারপর দেখা করবে মৃণালের মামা, দি মর্নিং স্টার পত্রিকার প্রাক্তন সিনেমা এডিটর মণিময় চ্যাটার্জির সঙ্গে। মৃন্ময় তাঁর সঙ্গে কথা বলে রেখেছে। যে কোনো দিন সন্ধের দিকে রণিতারা মণিময়ের বাড়ি যেতে পারে।
.
আজ দুপুরে লালবাজারে মিসিং পার্সনস ডিপার্টমেন্টে গেল রণিতা আর অমিতেশ। আগেই ওরা ফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে রেখেছিল।
অফিসার-ইন-চার্জ রণজয় সেন রণিতাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। বয়স চল্লিশের নিচে, বেতের মতো ছিপছিপে চেহারা। পুলিশ বলতে যে গভীর ভয়ঙ্কর একটা ছবি চোখের সামনে ফুটে ওঠে তিনি মোটেই তা নন। তাঁকে দেখলে মন ভাল হয়ে যায়।