জ্যোতির্ময় অমিতেশদের দেখে ডাকেন, আরে এস এস—
অমিতেশ জ্যোতির্ময়ের সামনে গিয়ে বসে।
আগেই রণিতার সঙ্গে জ্যোতির্ময়ের আলাপ হয়েছিল। হাসিমুখে চোখের ভুরু সামান্য তুলে বলেন, কী ব্যাপার রণিতা, এবার তোমার ডকুমেন্টারির কী থিম? রণিতাকে তিনি তুমি করেই বলেন।
রণিতা মজা করে হাসে, ও বাবা, বসতে না বসতেই কাজের কথা!
কাজ ছাড়া কি তোমার দর্শন পাওয়া যায়? জ্যোতির্ময়ও হাসতে থাকেন।
কথাটা ঠিক। একটু লজ্জা পেয়ে রণিতা বলে, অকারণে এসে আপনার সময় নষ্ট করার মানে হয় না। তাই–
জ্যোতির্ময়ের দুই চোখ নেচে ওঠে। বলেন, খুব শাহেনশা মেয়ে! চমৎকার ম্যানেজ করেছ। আজকালকার ছেলেছোকরাদের ইডিয়মগুলো তিনি ভালই জানেন এবং জায়গামতো প্রয়োগও করে থাকেন।
রণিতা শুধু হাসে, উত্তর দেয় না।
জ্যোতির্ময় এবার বলেন, নো সঙ্কোচ, নো লজ্জা, বল তোমাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি।
অমিতেশ রণিতার নতুন প্রোজেক্টটার কথা জানিয়ে দেয়।
নয়নতারা! দ্যাট গ্রেট লেডি অফ স্টেজ অ্যান্ড স্ক্রিন! বলে ভুরু কুঁচকে, চোখ বুজে অনেকক্ষণ যেন ধ্যানস্থ হয়ে থাকেন জ্যোতির্ময়, সেই অবস্থাতেই একসময় বলে ওঠেন, যতদূর মনে পড়ছে, ওঁরা ছিলেন ইস্ট বেঙ্গলের রিফিউজি, নাইনটিন ফর্টিনাইনে তখনকার পূর্ব পাকিস্তান থেকে কলকাতায় চলে আসেন। ফিফটিতে সিনেমায় নামেন। ফার্স্ট ছবি ফ্লপ, সেকেন্ড ছবি ফ্লপ, থার্ড ছবি ফ্লপ, ফোর্থ ছবি ফ্লপ, ফিফথ অ্যাভারেজ বিজনেস। ফিফটি টুতে ওঁর সিক্সথ ছবি জন্মভূমি রিলিজ করল। সুপার ডুপার হিট। তারপর থেকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। জন্মভূমি থেকেই একটা লিজেন্ডের জন্ম হল, শুরু হল ফ্যাবুলাস এন্ডলেস সাকসেস স্টোরি। বলতে বলতে চোখ খুলে ব্যস্তভাবে একজন অ্যাসিস্টান্টকে ডাকেন, সুরেশ, ডানদিকের ওয়ালের চার নম্বর বুক-কেসের ফিফথ তাক থেকে নয়নতারার ওপর চারটে ফাইল আছে। নিয়ে এস।
রণিতা জানে, এই লাইব্রেরির কোন আলমারি বা বুক-কেসে কোন ফাইল, কোন পেপার কাটিং বা বই আছে, সব চোখ বুজে বলে দিতে পারেন জ্যোতির্ময়।
বছর চল্লিশ বয়স সুরেশের, মাঝারি হাইট, নিরেট চেহারা। দুমিনিটের ভেতর চারখানা ঢাউস ফাইল এনে জ্যোতির্ময়ের টেবলে রাখে।
জ্যোতির্ময় রণিতাকে বলেন, এর ভেতর শুধু আমাদের কাগজেরই না, অন্য লিডিং ডেইলিরও বেশ কিছু পেপার কাটিং রয়েছে। আপাতত এগুলো দেখ। পরে ম্যাগাজিনের কাটিং আর ওঁর ফোটোও দেব। মনে হচ্ছে নয়নতারার সাত ভলিউম ফোটো অ্যালবাম আছে আমাদের লাইব্রেরিতে।
রণিতার ধারণা ছিল, উনিশ শ পঞ্চাশে নয়নতারা যখন প্রথম সিনেমায় নামেন সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত সব কাগজ ঘেঁটে ঘেঁটে তথ্য বার করতে হবে। এত সহজে সব পাওয়া যাবে ভাবতে পারেনি সে। জ্যোতির্ময় যেন তার জন্য সমস্ত কিছু আগে থেকেই সাজিয়ে রেখেছেন। মনে মনে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করে বণিতা।
হল-ঘরের মাঝখানে টানা লম্বা টেবলের দুপাশে সারি সারি চেয়ার পাতা রয়েছে, ওখানে বসে পড়ার ব্যবস্থা।
ফাইলগুলো নিয়ে রণিতা আর অমিতেশ পড়ার টেবলে চলে আসে।
অমিতেশ চারদিক ভাল করে লক্ষ করে গলা নামিয়ে বলে, তোমার এখানকার ব্যবস্থা হয়ে গেল। আমি কিন্তু এখনও সাসপেন্সে ঝুলে আছি। পূজ্যপাদ ভাবী শ্বশুরমশাই কী বললেন, এখনও জানাও নি।
রণিতা এই নিয়ে খানিকটা মজা করতে পারত, করল না। প্রথমত, নয়নতারা সম্পর্কিত পেপার কাটিং এবং ছবিগুলো দেখার জন্য ভেতরে ভেতরে সে খুবই উদগ্রীব হয়ে আছে। দ্বিতীয়ত, এই লাইব্রেরি ব্যক্তিগত বিষয়ে আলোচনার জায়গা নয়। তার জন্য আলাদা মুডও দরকার।
রণিতা বলে, বাবার সাপোর্ট আছে কিন্তু বিয়েটা তাড়াতাড়ি হবে বলে মনে হয় না। হোল ব্রিগেড অব রিলেটিভস ক্রিশ্চানকে বিয়ে করছি জানলে থার্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার বাধিয়ে দেবে। বাবা তাদের সামলাবার জন্যে সময় চেয়েছেন। ততদিন ধৈর্য ধরে ওয়েট করতে হবে, বুঝলে?
দুই হাতের তালু উলটে দেয় অমিতেশ। তার মুখে বিষণ্ণ হাসি ফোটে। বলে, বুঝলাম।
এবার যাও। আমি ফাইলগুলো খুলি।
যাচ্ছি। আমারও কটা জরুরি কাজ আছে, সেগুলো সেরে ফেলি। তুমি কতক্ষণ এখানে থাকবে?
চারটে, সাড়ে চারটে পর্যন্ত।
তখন আসব।
আচ্ছা।
অমিতেশ চলে যায়।
.
০৫.
দিন দশক কেটে গেল। এর মধ্যে দৈনিক কাগজের ফাইলগার ম্যাগাজিন ঘাঁটাঘাঁটি করে নয়নতারার অভিনয় জীবন সম্পর্কে পরিষ্কার একটা ধারণা হয়ে গেছে রণিতার। প্রচুর নোট নিয়েছে সে।
উনিশ শ পঞ্চাশে সিনেমায় নামার পর থেকে ছিয়াশিতে নিরুদ্দেশ হবার আগে পর্যন্ত সবসুদ্ধ একশ একুশটা ছবিতে নয়নতারা নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। জ্যোতির্ময় যা বলেছেন অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। প্রথম চারটে ছবির সবগুলোই তাঁর ফ্লপ হয়েছে। কুড়িটা ছবি মোটামুটি ব্যবসা করেছিল। বাকি সাতানব্বইটা ছবির প্রতিটি বক্স-অফিসের দিক থেকে দু কোটি টাকা পর্যন্ত লাভ করেছে। এ সবের কারণ নয়নতারার প্রবল স্ক্রিন পার্সোনালিটি, চমৎকার অভিনয়ের ক্ষমতা, চোখ-ঝলসানো গ্ল্যামার। তাঁর হাসিটি ছিল এমনই মাদকতাময় যে দর্শকের হৃৎপিণ্ডে ঘূর্ণিঝড় বইয়ে দিত। পনেরো বছরের কিশোর থেকে সত্তর বছরের বৃদ্ধ পর্যন্ত সব পুরুষের তিনি স্বপ্নের নায়িকা। তাঁর যে কোনো ছবি রিলিজ হওয়া মানেই তখনকার দিনের বিরাট ঘটনা। কম করে বানো চোদ্দ উইক প্রতিটি শো থাকত হাউসফুল। ব্ল্যাকাররা রমরমা ব্যবসা করত, পাঁচ টাকার টিকিট বেচত পনেরো কুড়ি টাকায়। তারা চাইত অন্তত মাসে একটা করে তাঁর ছবি রিলিজ করুক।