খুব অবাক হয়ে যায় রণিতা। বলে, আপনারা কি অডিওভিসুয়াল মিডিয়ায় আসতে চাইছেন?
প্রিন্ট মিডিয়ার সঙ্গে ওর তো কোনো বিরোধ নেই। হেসে হেসে পরাশর বলেন, অডিওভিসুয়াল মিডিয়া ভীষণ পাওয়ারফুল। আমরা ঠিক করেছি ঐ মিডিয়াতেও কিছু কাজ করব। নয়নতারার ওপর ডকু-ফিচার দিয়ে শুরু করতে পারলে রাতারাতি নেশানওয়াইড পাবলিসিটি পেয়ে যাব। আ ফ্যান্টাসটিক বিগিনিং।
রণিতা বলে, আপনাদের স্পনসরশিপে করতে পারলে ভালই হত কিন্তু দূরদর্শন প্রোজেক্টটা ছেড়ে দেবে বলে মনে হয় না।
একান্তই যদি না ছাড়ে, আমার অন্য একটা পোপোজাল আছে।
বলুন।
নয়নতারা সম্পর্কে একটা ধারাবাহিক লেখা আমাদের কাগজে লিখুন। কিভাবে তিনি স্টেজ এবংফিল্মে এলেন, কী কী ছবি করেছেন, তাঁর ব্যক্তিগত জীবন, সব ডিটেলে চাই। যে আট বছর তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে আছেন, তাঁকে খুঁজে বার করে সেই পিরিয়ডটার ওপর বিশেষভাবে জোর দেবেন। সেই সঙ্গে চাই এখনকার বিভিন্ন মুডের প্রচুর ছবি। প্রতি সপ্তাহে কাগজের একটা ফুল পেজ আপনাকে দেব। অ্যান্ড য়ু নো আওয়ার পেমেন্ট ইজ নট ব্যাড। উই উড পে হ্যান্ডসামলি। বলতে বলতে একটু থামেন পরাশর। টেবলের ওপর অনেকটা ঝুঁকে ফের শুরু করেন, সব মেটিরিয়াল তো আমাদের লাইব্রেরিতে পাবেন না। নানা জায়গায় ছোটাছুটি, বহু লোকের সঙ্গে মিট করা, স্টেশনারি–এ সবের জন্যে প্রচুর খরচ আছে হবে। আপাতত হাজার পাঁচেক টাকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
নয়নতারা সম্পর্কে মানুষের অফুরন্ত কৌতূহল। রণিতা বুঝতে পারছিল, তাঁর একটা ক্যানডিড বায়োগ্রাফি অর্থাৎ খোলামেলা অকপট জীবনী, বিশেষ করে অজানা রহস্যময় গত আটটি বছরের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ যদি নিয়মিত বেরুতে থাকে, নিকাল-এর সার্কুলেশন দেড় দুগুণ বেড়ে যাবে। পরাশরের আগ্রহ বা ইন্টারেস্টটা সেখানেই। সে বলে, এখন টাকা লাগবে না। কাজটা তো শুরু করি। পরে দরকার হলে বলব।
একটু চিন্তা করে পরাশর বলেন, ঠিক আছে। তবে আপনাকে একটা কথা দিতে হবে।
কী কথা?
লেখাটা কিন্তু আমরাই ছাপব। আমার অনুরোধ এ নিয়ে অন্য কোন কাগজের সঙ্গে কথা বলবেন না।
ঠিক আছে। কিন্তু—
আবার কী?
দ্বিধান্বিতভাবে রণিতা এবার বলে, কাগজে লেখার অভ্যাস তো আমার নেই। স্ক্রিপ্ট ছাড়া কিছুই লিখিনি। কেউ হেল্প না করলে আমি কি পারব?
মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেন পরাশর। অমিতেশের দিকে তাকিয়ে বলেন, মিস মিত্রকে তুমি সাহায্য করবে। ইটস আ সিরিয়াস ওয়র্ক। যখনই দরকার হবে অফিস থেকে এর জন্যে ছুটি নেবে।
আস্তে মাথা নাড়ে অমিতেশ।
পরাশর এবার রণিতাকে জিজ্ঞেস করেন, ছবি তোলার জন্যে তো লোক চাই। যখনই বলবেন, আমাদের একজন স্টাফ ফোটোগ্রাফার সব সময়ের জন্যে আপনাকে দিয়ে দেব।
রণিতা বলে, লাগবে না, ছবি আমিই তুলে নিতে পারব।
একটু চুপ।
তারপর পরাশর বলেন, কিভাবে কাজ শুরু করবেন, কিছু ঠিক করেছেন?
পরাশরকে তার পরিকল্পনার কথা জানিয়ে দেয় রণিতা।
পরাশর বলেন, ফাইন। আমার একটু সাজেশান আছে।
বলুন।
এর সঙ্গে আমাদের কাগজে বক্স নাম্বারে একটা নোটিশ দিয়ে দিন। নয়নতারাকে ঘনিষ্ঠভাবে জানে, ফিল্ম আর স্টেজ ওয়ার্ল্ডের ভেতরে এবং বাইরে এমন বহু মানুষ এখনও বেঁচে আছে। লিখবেন তাদের কাছে যদি কোনো অজানা তথ্য বা ফোটো থাকে যেন পাঠিয়ে দেয়। মনে হয়, এতে ভাল কাজ হবে। কুড়ি দিন পর পর দুমাস ধরে নোটিশটা বেরুবে। প্রথম বার মিস করলেও সেকেন্ড বা থার্ড টাইমে লোকের নজরে পড়বেই।
রণিতা বলে, গুড আইডিয়া। কিন্তু নোটিশটা কিভাবে দেব?
পরাশব বলেন, ও ব্যাপারে আপনাকে ভাবতে হবে না। অমিতেশকে বলেন, তুমি একটা ড্রাফট করে অ্যাড ম্যানেজারের হাতে দিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে বলবে।
অমিতেশ বলে, আচ্ছা স্যর।
পরাশর বলেন, তা হলে মিস মিত্র, আপনি লাইব্রেরিতে গিয়ে কাজ আরম্ভ করুন। গুড লাক।
রণিতা আর অমিতেশ উঠে দাঁড়ায়। রণিতা বলে, থ্যাঙ্ক য়ু স্যর।
সম্পাদকের কামরা থেকে বেরিয়ে সোজা চারতলায় লাইব্রেরিতে চলে এল রণিতারা।
প্রায় সাত আট হাজার স্কোয়ার ফুট জুড়ে উঁচু উঁচু কাঁচ আর কাঠের বুক কেসের ভেতর অজস্র বই এবং ম্যাগাজিন। আর আছে বাংলা, ইংরেজি আর হিন্দি ভাষার অজস্র খবরের কাগজ, সাল তারিখ অনুযায়ী সেগুলো সযত্নে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। চল্লিশ পঞ্চাশ বছর আগের পুরনো কাগজ মাইক্রো ফিল্ম করে রাখার ব্যবস্থাও আছে এখানে।
একধারে কোমর-সমান উঁচু ঘেরা জায়গায় লাইব্রেরিয়ান জ্যোতির্ময় বসাকের চেম্বার। এখন তিনি সেখানেই বসে আছেন। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি, পাতলা মেদহীন চেহারা, ধারাল নাক মুখ, সরু থুতনি, মাথায় কাঁচাপাকা চুল, ডান দিকে সিথি। চোখে হালকা ফ্রেমের বাইফোকাল চশমা। পরনে ট্রাউজার আর শার্ট। তাঁর সামনের মস্ত টেবলটায় বই আর ম্যাগাজিনের স্তূপ। দেখেই বোঝা যায়, ওগুলো নতুন এসেছে, এখনও নাম্বার লাগিয়ে বুক-কেসে ভোলা হয়নি। এছাড়া আছে টেলিফোন, কিছু ফাইল, টেবল ক্যালেন্ডার, ইত্যাদি।
জ্যোতির্ময় বসাকের তিন জন অ্যাসিস্টান্ট। কাল মর্নিং আর ইভনিং এডিশানের যে সব কাগজ এসেছে দুজন সেগুলো মোটা নাইলনের সুতো দিয়ে গেঁথে ফাইল করে রাখছে। অন্য অ্যাসিস্টান্টটি বইয়ের ধুলো টুলো ঝেড়ে সাফ করছে।