বছর চারেক হল দিনকাল-এ চাকরি পেয়েছে অমিতেশ। তারপর অসংখ্য বার এখানে এসেছে রণিতা। এই বিশাল, পাঁচতলা বাড়িটার গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকে টপ ফ্লোর পর্যন্ত কোথায় কী আছে, সব তার মুখস্থ।
দিনকাল অফিসে ঢোকার ব্যাপারে প্রচণ্ড কড়াকড়ি। কেননা এই কাগজে মাঝে মাঝে এমন সব রিপোর্ট বেরোয় যাতে রাজনৈতিক দল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে মস্তানরা এসে হামলা করে থাকে। তাই সবাইকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয় না। রিসেপশানের তুখোড় তরুণীটি যার নাম বিপাশা সেন, অবাঞ্ছিত ভিজিটরদের একতলাতেই আটকে দেয়। কিন্তু রণিতার ব্যাপারে বাধা নেই, তার কাছে এ অফিসের দরজা সব সময় খোলা।
বিপাশা রণিতাকে ভালই চেনে। মিষ্টি হেসে বলে, অমিতেশ দাস মিনিট দশেক হল এসেছেন। যান, চলে যান এ অফিসে নিয়মিত ভিজিটররা কে কার কাছে আসে, সব তার জানা।
রণিতাও হাসে। তারপর মাথাটা সামান্য ঝুঁকিয়ে থ্যাঙ্ক য়ু বলে রিসেপশান কাউন্টারের পাশ দিয়ে লিফটের দিকে চলে যায়।
তেতলায় আসতেই দেখা যায় নিউজ ডিপার্টমেন্টের প্রকাণ্ড হল-টা প্রায় ফাঁকা। সাব-এডিটরদের কেউ কেউ অবশ্য এসেছে। রিপোর্টিং সেকশানে অমিতেশ ছাড়া কেউ নেই, পার্সোনাল কম্পিউটারে বোম টিপে টিপে কী যেন কম্পোজ করছিল।
নিঝুম, প্রায় নির্জন হল-টায় সদা তৎপর টেলিপ্রিন্টার মেশিন দুটো শুধু খটখট আওয়াজ তুলে হিন্নি-দিল্লি-মক্কা-মদিনা-লন্ডন-প্যারিসের খবর দিয়ে যাচ্ছে। রণিতা জানে, খবরের কাগজের অফিস, বিশেষ করে নিউজ ডিপার্টমেন্ট জমে ওঠে বিকেলের পর থেকে। মারাত্মক কোনো ঘটনা না ঘটলে সকালের দিকটায় এখানে জড়িয়ে থাকে ঢিলেঢালা, আলস্যের ভাব।
রণিতাকে দেখে কম্পিউটারে কম্পোজ বন্ধ করে অমিতেশ বলে, এস এস। একেবারে ব্রিটিশ পাংচুয়ালিটি! এগারোটা মানে এগারোটাই।
একটু হেসে মুখোমুখি এসে বসে রণিতা।
অমিতেশের বয়স তিরিশ একত্রিশ। বেশ ভাল হাইট তার। লম্বাটে মুখে সযত্নে ছাঁটা দাড়ি, চুল ব্যাকব্রাশ করা, গায়ের রং তামাটে, চওড়া কপাল, বড় বড় চোখের দৃষ্টি শান্ত কিন্তু দুরভেদী। পরনে এই মুহূর্তে দামি কটনের ট্রাউজার আর টি-শার্ট। বাঁ হাতে চৌকো জাপানি ঘড়ি।
অমিতেশ বলে, এডিটরের পারমিশান পেয়ে গেছি। তারপর ফোন তুলে অপারেটরকে সম্পাদকের ঘরে লাইনটা দিতে বলে। যোগাযোগ হলে সে জিজ্ঞেস করে, স্যার, রণিতা এসে গেছে। ওকে কি নিয়ে যাব?
ওধার থেকে খুব সম্ভব সম্পাদকের সম্মতি পাওয়া যায়। ফোন নামিয়ে রেখে অমিতেশ বলে, চল, এডিটর তোমাকে দেখা করতে বলেছেন।
রণিতা খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল। বলে, কী ব্যাপার? এর আগেও কত বার তোমাদের লাইব্রেরিতে পেপার টেপার দেখেছি, উনি তো কখনও দেখা করার কথা বলেননি।
এবার দরকার হয়েছে। এস।
হল-ঘরের ডান দিকে অনেকটা জায়গা জুড়ে সম্পাদক পরাশর বসুর চেম্বার। আগাগোড়া কাঠের প্যানেল-করা চেম্বারটা চমৎকার সাজানো। দামি কাশ্মীরি কার্পেটে ওয়াল টু ওয়াল গোটা ফ্লোরটা মোড়া। কাঁচ আর কাঠের সুদৃশ্য ক্যাবিনেট অজস্র রেফারেন্সের বই। মাঝখানে বিশাল অর্ধবৃত্তাকার টেবলের ওধারে সম্পাদকের পুরু গদিওলা রিভলভিং চেয়ার। টেবলের এধারে আরো ডজন দেড়েক চেয়ার, সেগুলো দর্শনার্থীদের জন্য। টেবলের ওপর দশ বারোটা নানা রঙের টেলিফোন, কিছু ফাইল, পেন-হোল্ডারে গোটাকয়েক পেন যার সবগুলোই বিদেশি। আর আছে টেবল ক্যালেন্ডার, একটা বড় গ্লোব, ঘোট কম্পিউটার ইত্যাদি।
রণিতারা ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পেল নির্দিষ্ট চেয়ারটিতে বসে আছেন পরাশর। বয়স ছাপ্পান্ন সাতান্ন, নিখুঁত কামানো মুখ, গায়ের রং লালচে। মাথায় কাঁচাপাকা চুল, ভারি গম্ভীর মুখে মোটা ফ্রেমের চশমা। দেখামাত্র টের পাওয়া যায় এই মানুষটির মধ্যে রয়েছে প্রবল, অনমনীয় এক ব্যক্তিত্ব।
পরাশর বলেন, বসুন মিস মিত্র, তুমিও বসো অমিতেশ।
রণিতারা টেবলের এধারে তাঁর মুখোমুখি বসে পড়ে।
পরাশর রণিতার দিকে তাকিয়ে বলেন, আগে কফি খান, তারপর কাজের কথা শুরু করা যাবে।
দিনকাল অফিসে মাঝে মাঝে এলেও পরাশরের সঙ্গে আগে রণিতার আলাপ হয়নি। আলাপের কারণও ছিল না। লাইব্রেরিতে কাগজপত্র দেখার পারমিশান তাকে বরাবরই এনে দিয়েছে অমিতেশ। ব্যস, ঐ পর্যন্ত। তবে পরাশরকে অনেক বার দূর থেকে দেখেছে সে! অল্প হেসে বলে, ঠিক আছে।
বেয়ারাকে দিয়ে কফি আনিয়ে হালকা চুমুক দিতে দিতে পরাশর বলেন, অমিতেশের কাছে শুনলাম নয়নতারাকে নিয়ে আপনি একটা ডকু-ফিচার করতে চাইছেন। এ ব্যাপারে আমরা ইন্টারেস্টেড।
টেবল থেকে কফির কাপ খানিকটা তুলেছিল রণিতা, আস্তে আস্তে সেটা নামিয়ে রাখে। পরাশরকে লক্ষ করতে করতে তার আগ্রহের কারণটা বুঝতে চেষ্টা করে।
পরাশর জিজ্ঞেস করেন, প্রোজেক্টটা কী অবস্থায় আছে?
রণিতা বলে, কী অবস্থায় বলতে?
অমিতেশ বলছিল দূরদর্শন ওটাকরার জন্যে আপনাকে কমিশন করতে চায়।
হ্যাঁ।
আপনার সঙ্গে ওদের এগ্রিমেন্ট হয়ে গেছে?
এত কথা কেন পরাশর জানতে চাইছেন, বুঝতে পারছিল না রণিতা। সে বলে, এখনও হয়নি। দিন পনেরোর ভেতর ওরা আমাকে দিল্লি যেতে বলেছে। আশা করি তখন হয়ে যাবে।
পরাশর বলেন, যদি কোনো কারণে না হয় জানাবেন। আমরা প্রোজেক্টটা স্পনসর করব।