রণিতা চমকে ওঠে, সে কী! তুমি–
হাত তুলে মেয়েকে থামিয়ে দিয়ে ইন্দ্রনাথ বলেন, আরে বাবা, এক্ষুণি আমি ঢাল পিটিয়ে কাউকে জানাতে যাচ্ছি নাকি? ধীরে ধীরে. সইয়ে সইয়ে, সবার পালস বুঝে কথাটা তুলব। তাড়াহুড়ো করতে গেলে গোলমাল হয়ে যাবে।
রণিতা বুঝতে পারে, অধৈর্য হলে চলবে না। তাদের বংশে এখন পর্যন্ত জাত গোত্র মিলিয়ে এবং যোক দেখে বিয়ে হয়েছে। পারিবারিক সেই প্রথাকে ভাঙা খুব সহজ নয়। এখানে শুধু জাতের ব্যাপার নয়, অমিতেশদের ধর্মও আলাদা। ফলে সমস্যাটা আরো জটিল এবং স্পর্শকাতর। বাবার ওপর তার চিরকালই অগাধ বিশ্বাস, তিনি সবাইকে দিয়ে এ বিয়ে যে মানিয়ে নিতে পারবেন, সে সম্বন্ধে তার সংশয় নেই। তবু–
ইন্দ্রনাথ এবার বলেন, আসল খবরটা কিন্তু এখনও পাইনি।
রণিতা অবাক হয়ে বলে, আসল বলতে!
ছেলেটা কিরকম? অনেস্ট আর সিনসিয়ার তো?
আমার তো তাই মনে হয়।
ওর সঙ্গে কতদিনের পরিচয়?
দশ বছরের। আমি যেবার প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি হলাম ও তখন থার্ড ইয়ারে। সেই থেকে–
ঠিক আছে।
একটু চুপ।
তারপর আদুরে গলায় রণিতা বলে, বাবা, কাল কি পরশু বিকেলে তোমার কি একটু সময় হবে?
ইন্দ্রনাথ জিজ্ঞেস করেন, কেন?
অমিতকে তোমার কাছে নিয়ে আসতাম।
এখন না। কবে আনবি পরে বলে দেব।
রণিতা আর কিছু বলে না। সে বুঝতে পারে, তাদের বিয়ের ব্যাপারে মনের দিক থেকে পুরোপুরি প্রস্তুত না হয়ে ইন্দ্রনাথ অমিতেশের সঙ্গে আলাপ করবেন না।
.
০৪.
পরদিন সকালে চা খাওয়ার পর নিজের ঘরে বসে ন্যাশনাল লাইব্রেরি থেকে টুকে আনা আগের দিনের নোটগুলো দেখছিল রণিতা, এই সময় হল-ঘরে ফোন বেজে উঠল। বেরিয়ে এসে সেটা তুলে কানে ঠেকাতেই ওধার থেকে অমিতেশের গলা ভেসে এল, কে, রণি?
হ্যাঁ। দ্রুত চারপাশ একবার দেখে নিল রণিতা। হলঘরট এখন একেবারে ফাঁকা। ইন্দ্রনাথ তাঁদের বেডরুমে শুয়ে শুয়ে খবরের কাগজ পড়ছেন। সুধাময়ী আশেপাশে কোথাও নেই, রোজ সকালের দিকে দশটা পর্যন্ত তাঁর পুজোর ঘরে কেটে যায়।
অমিতেশ জিজ্ঞেস করে, আজ সকালে ফোন করতে বলেছিলে কেন?
রণিতা বলে, মৃণাল তোমাকে কিছু বলেনি?
ওর সঙ্গে দেখা হয়নি। কাল রাতে সাড়ে এগারোটায় ফরাক্কা থেকে ফিরেছি। মৃণাল তার আগেই চলে গেছে। তবে তোমার মেসেজটা রেখে গিয়েছিল। বল কী করতে হবে।
নয়নতারাকে নিয়ে ডকু-ফিচারের পরিকল্পনাটা সংক্ষেপে জানিয়ে রণিতা বলে, তোমাদের অফিস লাইব্রেরিতে আজ থেকেই কাজ শুরু করতে চাই। তুমি ব্যবস্থা করে দাও।
রীতিমত উত্তেজিতই হয়ে ওঠে অমিতেশ। বলে, এ তো দারুণ প্রোজেক্ট। লাইব্রেরির ব্যাপারটা হয়ে যাবে। নো প্রবলেম। অফিসে চলে এসো।
কখন আসব বল–
এডিটর এগারোটায় অফিসে আসেন, তুমি তখনই আসতে পার। ওঁকে একবার শুধু বলে নিতে হবে।
ঠিক আছে। তোমাকে আরেকটা ব্যাপারে সাহায্য করতে হবে।
কী সেটা?
নানা সোর্স থেকে নয়নতারা সম্পর্কে ডাটা জোগাড় করতে পারব। কিন্তু দ্যাটস নট সাফিসিয়েন্ট। আসল মানুষটাকে না পেলে ডকু-ফিচারটা ড্রাব, লাইফললস হয়ে যাবে, কোনো চার্ম থাকবে না। ওঁকে খুঁজে বার করার দায়িত্ব তোমাকেই নিতে হবে কিন্তু।
ওরে বাবা! গলার স্বর শুনে মনে হয় আঁতকে উঠেছে অমিতেশ, রিপোটারকে তুমি প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর বানাতে চাইছ। ক্রিমিনাল হয়, পলিটিক্যাল লিডার হয়, তাদের খোঁজ তবু করতে পারি। এ সব আমার জুরিসডিকশানে পড়ে। তুমি ছাড়া অন্য কোনো মহিলার পেছনে কখনও ঘুরিনি। কিন্তু এ একেবারে চলচ্চিত্রের হিরোইন, এক সময়ের গ্ল্যামার কুইন। স্রেফ মরে যাব রণি।
রণিতা ধমকে ওঠে, ইয়ার্কি করো না। দু উইক টাইম দিলাম, তার ভেতর নয়নতারাকে চাই। মনে রেখো, এখন থেকে তিন মাসের মাথায় শুটিং শুরু করব।
ঠিক হ্যায় শ্রীমতীজি, তাই হবে। যিনি আট বছর আগে নিখোঁজ হয়েছেন তাঁর পাত্তা লাগাতে পারব কিনা জানি না, তবে একটা এক্সপিরিয়েন্স তো হবে।
একটু চুপচাপ।
তারপর গলার স্বর অনেকটা নিচে নামিয়ে গোপন ষড়যন্ত্রকারীরমতো রণিতা বলে, তোমার আর আমার ব্যাপারে একটা দারুণ ডেভলপমেন্ট হয়েছে।
উৎসুক সুরে অমিতেশ জিজ্ঞেস করে, কিরকম?
কাল বাবাকে তোমার কথা বলেছি।
ইজ ইট?
ইয়া—
কী বললেন তিনি?
কণ্ঠস্বরে বোঝা যায়, অমিতেশের মধ্যে প্রবল উত্তেজনা চারিয়ে গেছে। রণিতা বলে, তোমার অফিসে গিয়ে বলব।
অমিতেশ তবু জানতে চায়, ফেভারেবল তো?
এখন সাড়ে আটটা বাজে। ঠিক এগারোটায় তোমাদের অফিসে পোঁছচ্ছি। আড়াই ঘন্টা সাসপেন্সে থাকো।
ঠিক আছে। দশ বছর যখন নাকে বঁড়শি আটকে ঝুলিয়ে রেখেছ তখন আরো আড়াই ঘন্টাও ঝুলে থাকতে পারব।
সময়ের ব্যাপারে ভীষণ সচেতন রণিতা। কাঁটায় কাঁটায় এগারোটায় দিনকাল অফিসে পৌঁছে যায়।
বাড়িটা পাঁচতলা এবং আগাগোড়া এয়ার-কণ্ডিশনড। একতলায় রিসেপশন, প্রেস, সাকুলেশন, ইত্যাদি নানা ডিপার্টমেন্ট। দোতলার বেশির ভাগটা জুড়ে বিজ্ঞাপন বিভাগ। দিনকাল-এর তিনটে ম্যাগাজিন আছে- দুটো উইকলি, একটা ফোর্টনাইটলি। সেগুলোর দপ্তরও দোতলাতেই। তেতলার গোটাটা নিয়ে নিউজ এবং এডিটোরিয়াল ডিপার্টমেন্ট। এখানে বিরাট একটা হল ঘিরে এডিটর, নিউজ এডিটর, চিফ রিপোর্টার, ফিচার এডিটর, ফিল্ম এডিটরদের জন্য ছোট বড় মাঝারি, নানা সাইজের চেম্বার। হলঘরের একটা দিক সাব-এডিটর এবং অন্য দিকটা রিপোর্টারদের জন্য সংরক্ষিত। প্রত্যেকের টেবলেই রয়েছে ছোট ছোট পার্সোনাল কম্পিউটার। দুই এলাকার সীমানায় পি টি আই আর ইউ এন আই-এর টেলিপ্রিন্টার। চারতলায় অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিস এবং লাইব্রেরি। পাঁচতলায় ক্যান্টিন, ফোটোগ্রাফি আর আর্ট ডিপার্টমেন্ট।