- বইয়ের নামঃ এক নায়িকার উপাখ্যান
- লেখকের নামঃ চিত্তরঞ্জন মাইতি
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১-৫. সন্ধের আগে
এক নায়িকার উপাখ্যান – উপন্যাস – চিত্তরঞ্জন মাইতি
সন্ধের আগে আগে আজ বাড়ি ফিরে এল রণিতা। তার বয়স সবে সাতাশ পেরিয়েছে। ইস্পাতের ফলার মতো মেদশূন্য, ঝকঝকে চেহারা। ধারাল, লম্বাটে মুখ। চিবুকের দৃঢ়তা, বড় বড় চোখের গভীর, উজ্জ্বল দৃষ্টি এবং কাঁধ পর্যন্ত ছাঁটা উড়ন্ত বাদামি চুল তার মধ্যে এনে দিয়েছে দারুণ এক ব্যক্তিত্ব। তাকে বাঙালি তো নয়ই, কেমন যেন অভারতীয় মনে হয়। পুরনো উপমা দিয়ে বলা যায়, রণিতার গায়ের রং একদা ছিল স্বর্ণাভ আশ্বিনের রৌদ্রঝলকের মতো। কিন্তু রোদে পুড়ে, জলে ভিজে চামড়া ট্যান হয়ে গেছে। তার যা কাজ তাতে ভারতীয় ঋতুগুলির তীব্র উত্তাপ বা শীতলতা থেকে নিজেকে বাঁচানো অসম্ভব। দার্জিলিং-এর চা-বাগানে, আসামের জঙ্গলে, মধ্যপ্রদেশ কি ওড়িশার আদিবাসী গ্রামে ব্যস্ত ভূপর্যটকের মতো তাকে আকছার ছুটে বেড়াতে হয়। তার কাজটাই অনেকের থেকে আলাদা কিন্তু সে কথা পরে।
রণিতার পরনে এই মুহূর্তে ফেডেড জিনস আর শার্ট, পায়ে পুরু সোলেব লেডিজ শ্যু, বাঁ হাতে চওড়া স্টিল ব্যাণ্ডে ওভাল শেপের ঘড়ি, গলায় লম্বা সৰু সোনার চেইন যার লকেট হল একটা বড় সাইজের ক্রস। রণিতা নিষ্ঠাবান হিন্দু মা-বাবার সন্তান, নিজেকে সে অবশ্য বলে নন-প্র্যাকটিসিং হিন্দু। ক্রসটা সম্পর্কে জানতে চাইলে তার উত্তর–এক মহামানবের জীবনদানের প্রতীক ওটা। ক্রসটা নাকি তাকে কখনও ভেঙে পড়তে দেয় না, সারাক্ষণ অফুরান সাহস জুগিয়ে যায়। এটা সম্পূর্ণ নিজস্ব বিশ্বাসের ব্যাপার। এছাড়া কাঁধ থেকে একটা ঢাউস চামড়ার ব্যাগ ঝুলছে। ওটার ভেতরে কী নেই? ক্যামেরা, বিরাট সাইজের ডায়েরি, পেন, পেন্সিল থেকে শুরু করে নানা বই এবং ম্যাগাজিন থেকে টুকে আনা গোছ গোছ নোটস, নিজের লেখা দু-একটা ফিল্ম স্ক্রিপ্ট, ইত্যাদি।
রণিতাদের বাড়িটা ও বালিগঞ্জের এক নিরিবিলি পাড়ায়। নাম অন্তরা। পঞ্চাশ বছর আগে এটা তৈরি করিয়েছিলেন তার ঠাকুরদা, নামকরণও তাঁরই। রণিতাদের পদবি মিত্র। সেই হিসেবে মিত্র নিবাস, মিত্র ভিলা বা মিত্র লজ হওয়াই ছিল স্বাভাবিক। শান্তিনীড় কি সন্ধ্যাদীপও হতে পারত।
তার জায়গায় কিনা অন্তরা। নামটার ভেতর গানের সুরেলা ঝংকার রয়েছে। ঠাকুরদা কবেই মারা গেছেন, রণিতার জন্মেরও বেশ কয়েক বছর আগে, তবু এমন একটা চমৎকার নামের জন্য সে এখনও ভদ্রলোককে দশবার কুর্নিশ করে।
ফুটপাথের গা ঘেঁষে লোহার ভারি গেট। সেটা ঠেলে ভেতরে ঢুকে আসে রণিতা।
গেটের পর থেকেই মাঝারি মাপের ছিমছাম বাগান। সেখানে সবুজ ঘাসের কার্পেট, বট আর অশ্বথের বনসাই, ছাতার আকারের সারি সারি ঝাউ এবং সিলভার পাইনের লাইন। আর আছে নানা চেহারার মরশুমি ফুলের গাছ। প্রতিটি গাছের সতেজ পাতায় বা ফুলে রয়েছে যত্ন, পরিশ্রম ও মমতার ছাপ। এমন একখানা চমৎকার বাগান নিজের থেকে তৈরি হয়নি, ঢালতে হয়েছে প্রচুর টাকা।
বাগানটাকে দুভাগ করে মাঝখান দিয়ে মুড়ির পথ চলে গেছে। রণিতা নুড়ির ওপর পা ফেলে ফেলে চলে আসে গাড়ি-বারান্দায়। তারপর চওড়া চওড়া দশটা সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতেই সেগুন কাঠের কারুকাজ-করা প্রকাণ্ড দরজা। তার গায়ে কলিং বেলের সুইচ। রণিতা সেটায় আঙুলের চাপ দিতেই ভেতর থেকে পিয়ানোর টুং টাং আওয়াজ ভেসে আসে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দরজা খুলে তার সামনে দাঁড়ায় অনাথ।
নিরেট চেহারার মাঝবয়সী এই কাজের লোকটি তিরিশ বছর এ বাড়িতে আছে। পরনে খাটো ধুতি আর মোটা লং ক্লথের হাফ-হাতা পাঞ্জাবি। এই পোশাকেই তাকে আজন্ম দেখে আসছে রণিতা।
অনাথ খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল। বলে, ছোটদিদি, তুমি! অ্যাত তাড়াতাড়ি ফিরে এলে। তার আদি বাড়ি লীকান্তপুর লাইনের কোনো একটা গ্রামে। তিরিশটা বছর বালিগঞ্জের মতো জায়গায় কেটে গেল, তবু তার জিভ থেকে এখনও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার আঞ্চলিক টানটা মুছে যায়নি।
অনাথের বিস্ময়ের কারণ আছে। কেননা রণিতা রাতে সাড়ে আটটা নটার আগে ফেরে না। কোনো কোনো দিন আরো দেরি হয়ে যায়। আজ সে গিয়েছিল ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে। মধ্যপ্রদেশের আদিবাসী মারিয়াদের সম্বন্ধে বেশ কটা বই পড়ে অনেক নোট নিয়েছে। সেখান থেকে তার যাবার কথা ছিল শিশির মঞ্চে। নিউ ফিল্ম ক্লাব সন্ধ্যায় ফেদেরিকো ফেলিনির লা স্ট্রাডা ছবিটা ওখানে দেখাবার ব্যবস্থা করেছে। রণিতা ওই ক্লাবের মেম্বার। কিন্তু ন্যাশনাল লাইব্রেরির কাজটা শেষ হবার পর কেন যেন শিশির মঞ্চে যেতে ইচ্ছা হল না। হয়তো ভেতরে ভেতরে ক্লান্তি জমে ছিল, সোজা সে বাড়ি চলে আসে। এ সপ্তাহেই ছবিটার আরেকটা শো হবে, তখন দেখে নেওয়া যাবে।
এমনি চলে এলাম– ভাসা ভাসা উত্তর দিয়ে অনাথের পাশ দিয়ে ভেতরে চলে আসে রণিতা।
দরজার পর থেকেই বেশ চওড়া একটা প্যাসেজ। তার দুধারে ড্রইং রুম, ডাইনিং হল, কিচেন, স্টোর এবং কাজের লোকদের থাকার ঘর।
নাম বাদ দিলে এই দোতলা বাড়িটার সমস্ত কিছুতেই প্রাচীন কালের ছাপ। গাড়ি-বারান্দার সিঁড়ি থেকে শুরু করে সবগুলো ঘরের মেঝেই শ্বেত পাথরে মোড়া। দরজাগুলো পুরু এবং ভারি ভারি। জানালায় খড়খড়ি ছাড়াও রঙিন কাঁচের শার্সি। সিলিংয়ে এবং দেওয়ালে পঙ্খের নিখুঁত নকশা। মেহগনি কাঠের জমকালো ক্যাবিনেট, ল্যাম্প শেড, চার ব্লেডের ফ্যান-সব যেন পঞ্চাশ বছর আগের সময়টাকে গভীর আবেগে ধরে রেখেছে।