মিসির আলি সাহেব।
জি।
আপনার ঘরে তো টিভি-ভিসিআর কিছুই নাই। ছবি যখন দেখতে ইচ্ছা করবে চলে আসবেন।
জি আচ্ছা।
আপনাকে আমি পরিবারের একজন বলে মনে করি। আপনি একা একা থাকেন, খুবই মায়া লাগে।
মিসির আলি ছবির দিকে মন দিতে পারছেন না। বাড়িওয়ালা ক্ৰমাগত কথা বলে যাচ্ছেন। তবে এ বাড়ির অন্যদের তাতে অসুবিধা হচ্ছে না। তারা আজমল সাহেবের ধারাবাহিক কথা বলার মধ্যেও ছবি দেখতে অভ্যস্ত।
মিসির আলি সাহেব!
জি।
বিয়ে-শাদির কথা কি কিছু ভাবছেন? পুরুষ মানুষ যে কোনো বয়সে বিবাহ করতে পারে। হাসান-হোসেনকে মোরল যে ইয়াজিদ তার পিতা আশি বছর বয়সে বিবাহ করেছিলেন। বিষাদসিন্ধুতে পড়েছি। মারাত্মক বই। বিষাদসিন্ধু পড়েছেন?
জি।
কত বার পড়েছেন?
একবারই পড়েছি।
আমি সময় পেলেই পড়ি। প্রথম পড়েছিলাম। অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র থাকার সময়, শেষ পড়েছি গত রমজানে। নোবেল প্রাইজ পাওয়ার মতো বই। ঠিক কি না বলুন তো?
মিসির আলি কিছু বলার আগেই রেবু বলল, মামা চুপ করে তো। তোমার কথার যন্ত্রণায় উনি ছবিটা ঠিকমতো দেখতে পারছেন না। মানুষ এত কথা বলতে পারে, উফ।
ভাগ্নির কথায় আজমল সাহেব রাগ করলেন না। বরং খুশি খুশি গলায় বললেন, রেবু, ইয়াজিদের বাবার নাম তোর মনে আছে? তুই তো বিষাদসিন্ধু পড়েছিস।
ইয়াজিদের বাবার নাম মোয়াবিয়া।
ও আচ্ছা মোয়াবিয়া, এখন মনে পড়েছে।
মামা চুপ করে থাক। ছবি এখন শেষের দিকে চলে এসেছে। হাই টেনশন।
আজমল সাহেব চুপ করলেন। মিসির আলি গভীর মনোযোগে ছবি দেখছেন। আজমল সাহেবের কথাই সত্যি হয়েছে। খুনি-ভাই পুলিশ-ভাইযের হাতে মারা গিয়েছে। শেষ দৃশ্যে পুলিশ-ভাইয়ের সঙ্গে মেয়েটির বিবাহ। বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রী খুনি-ভাইয়ের বিশাল একটা অয়েল পেইনটিংয়ের সামনে দাঁড়িয়েছে। দুজনের চোখেই পানি। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে অয়েল পেইনটিংয়ের চোখেও অশ্রু টলমল করছে।
দর্শকদের মধ্যে রেবুর চোখেও পানি। শুধু আজমল সাহেবের মুখভর্তি হাসি। তিনি মিসির আলির দিকে ঝুঁকে এসে বললেন, বলেছিলাম না ফর্মুলা মতো কাহিনী শেষ হবে!
মিসির আলি বললেন, তাই দেখলাম। আজ উঠি।
ছাতা নিয়ে যান। বাইরে এখনো বৃষ্টি হচ্ছে।
মিসির আলি ছাতা হাতে নিলেন। আজমল সাহেব বললেন, কাজের ছেলেটাকে পাঠাচ্ছি। তার হাতে ছাতাটা দিয়ে দেবেন। আপনি যে মানুষ, দেখা যাবে ঘরের বাইরে ছাতা রেখে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। ভালো কথা, আগামী বিষ্যুদবার রাতটা ফ্রি রাখবেন। আমার পীর ভাই আসবেন। হালকা-জিকির হবে। দেয়া করা হবে। পীর ভাই কোরানে হাফেজ। তাঁর ক্ষমতা মারাত্মক।
কী ক্ষমতা?
বাতেনি ক্ষমতা। এইসব আপনারা বুঝবেন না। সায়েন্স দিয়ে এই জিনিস বোঝা যায় না। পীর ভাইকে আমি আপনার সঙ্গে পরিচয় কবিয়ে দিব। ঠিক আছে?
মিসির আলি নিজের ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তিনটা ঘটনা ঘটল। বৃষ্টি থেমে গেল, ইলেকট্রসিটি চলে এল এবং মিসির আলির ভয় করতে লাগল। তাঁর মনে হল, কেউ একজন বাড়িতে হাঁটাইটি করছে। এরকম মনে করার কোনোই কারণ নেই। যদি ঘর অন্ধকার থাকত তা হলে ভয় পাওয়ার ব্যাপারটার ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যেত। ঘরে আলো আছে! মিসির আলি যে দুর্বল মনের মানুষ তাও না। অশরীরী কোনো কিছুতেই তাঁর বিশ্বাস নেই। তা হলে ভয়টা তিনি পাচ্ছেন কেন?
রান্নাঘরে খুঁটিখাট খুঁটিখাট শব্দ হচ্ছে। কেউ কি আছে রান্নাঘরে? রান্নাঘরে বাতি জুলছে না। অশরীরী কেউ অন্ধকারে রান্নাবান্না করছে নাকি? মিসির আলি রান্নাঘরে ঢুকলেন। বাতি জ্বালালেন। কেউ নেই। তিনি বাতি জ্বালিয়ে রেখেই শোবার ঘরে ঢুকলেন। মনে হচ্ছে আজ রাতে ঘুম আসবে না। ঘুম যখন আসবেই না। শুধু শুধু বিছানায় গড়াগড়ি করার কোনো অর্থ হয় না। তার চেয়ে বিছানায় পা তুলে বসে জটিল কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা করা যায়।
চিন্তা করার মতো জটিল বিষয় এই মুহুর্তে তার কাছে আছে। একটু আগে যে ছবিটা দেখেছেন সেই ছবির একটা বিষয়ে বড় ধরনের খটকা তাঁর মনে তৈরি হয়েছে। ছবির গুণ্ডা-ভাইট যখন গুলি খেল তখন তিনি দেখেছেন গুণ্ডাটার হাওয়াই শার্টের তিন নম্বর বোতামটা নেই। অথচ গুণ্ডাটা যখন তার প্রেমিকার কোলে মাথা রেখে মারা যাচ্ছে তখন দেখা গেল। তিন নাম্বার বোতামটা ঠিকই আছে। এটা কী করে সম্ভব? গুলি খাওয়া গুণ্ডাটার সেবা না করে প্রেমিকা মেয়েটি কি শার্টের বোতাম লাগিয়েছে? খুবই অবিশ্বাস্য ব্যাপার। তবে যদি এমন কোনো লোকজ বিশ্বাস থাকে যে মৃত্যুপথযাত্রীর শার্টের বোতাম না থাকা অলক্ষণ, তা হলে একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করা যায়। মেয়েটা অলক্ষণের কথা বিবেচনা করে কোনো এক ফাঁকে শার্টে বোতাম লাগিয়েছে। মৃত্যুপথযাত্রীদের নিয়ে অনেক কুসংস্কার কাজ করে। যেমন মৃত্যুপথযাত্রীর ঘরে কোনো পাখি ঢুকে পড়া বিরাট অলক্ষণ। গ্লাস থেকে পানি পড়ে যাওয়া অলক্ষণ। জুতা বা স্যান্ডেল উল্টে যাওযা গুপ্তফণ। শার্টের বোতাম না থাকাও হয়তো অলক্ষণ।
মিসির আলি গভীর চিন্তায় মগ্ন হলেন।
মেয়ের নাম আঁখিতারা
মেয়ের নাম আঁখিতারা।
নেত্রকোনার অতি অজপাড়াগাঁর মেয়ের জন্য খুবই আধুনিক নাম। বয়স দশ থেকে এগারো। শশকের মতো ভীত চোখ। মিসির আলি ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেললেন। তার কাছে মনে হলো মেয়েটি রবীন্দ্ৰনাথের ‘পোস্টমাস্টার’-এর মেয়েটির চেয়েও অসহায়। ‘পোস্টমাস্টার’-এর মেয়ে ছিল নিজের গ্রামে। এই মেয়েটি হঠাৎ উঠে এসেছে অতি আধুনিক এক শহরে। আজমল সাহেব মিসির